দীর্ঘ ৮ মাস সংস্কার শেষে সবার জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে অযত্ন, অবহেলা ও ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে থাকা প্রায় ৩৬০ বছরের পুরোনো ঢাকার ঐতিহাসিক ‘ঢাকা গেট’। ফটকটি ফিরে পেয়েছে তার নিজস্ব হারানো রূপ। একইসঙ্গে এটি মীর জুমলা গেট, রমনা গেট ও ময়মনসিংহ গেট নামে পরিচিত। মীর জুমলার আসাম অভিযানের ‘বিবি মরিয়ম’ কামানটিও ওসমানী উদ্যান থেকে এনে ঢাকা গেটের পাশে স্থাপন করা হয়েছে।
২৪ জানুয়ারি, বুধবার বিকেলে আনুষ্ঠানিকভাবে এ গেটের উদ্বোধন করেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস। পরে চত্বরে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে গেটটি নিয়ে একটি ইতিহাসভিত্তিক প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়। এসময় বক্তব্য দেন ঢাকা সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মিজানুর রহমান এবং এশিয়া প্যাসেফিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবু সাঈদ এম আহমেদ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন নেতার মাজার সংলগ্ন এলাকায় সংস্কার পরবর্তী ঐতিহাসিক ‘ঢাকা ফটক’ উদ্বোধন করতে পারায় প্রথম সন্তানের মতো আনন্দিত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ঢাদসিক) মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস।
উদ্বোধনী বক্তব্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, আমরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম, ঢাকাকে তার গর্বের ও ঐতিহ্যের জায়গায় ফিরিয়ে নেব এবং নতুন প্রজন্মের জন্য ঐতিহ্যকে সংরক্ষণ করব। সেই প্রতিশ্রুতির একটি বড় অর্জন আজকে করতে পেরেছি। ১৬৬০ থেকে ১৬৬৩ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত মোগল সাম্রাজ্যের সুবেদার মীর জুমলার ঢাকা গেটকে দেশবাসীসহ সারাবিশ্বের কাছে তুলে ধরতে পারলাম। এটি আমাদের কাছে একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত।
এই সংস্কার কাজের মাধ্যমে দুটো বিষয়কে পুনরুজ্জীবিত করা হয়েছে জানিয়ে ডিএসসিসি মেয়র বলেন, আমার প্রথম সন্তান যেদিন হয়েছিল, সেদিন যে রকম আনন্দিত হয়েছিলাম আমি আজকে সে রকম আনন্দ বোধ করছি। আজকে আমরা একটি ইতিহাসকে পুনরুজ্জীবিত করেছি, সে রকম একটি আবেগ-উপলব্দি আমার মধ্যে কাজ করছে। ছোটবেলায় যখন আমরা গুলিস্তান দিয়ে যেতাম তখন এই কামানের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। অনেকে দেখতাম সেই কামানের উপর খেলাধুলা করছে। এটা হারিয়ে গিয়েছিল। এই কামান দিয়ে মীর জুমলা আসাম আক্রমণ করেছিলেন এবং আসাম বিজয় করেছিলেন। সেই কামানটি এখন ঢাকা ফটক প্রাঙণে আমরা নিয়ে এসেছি। সুতরাং আমরা দুটি বিষয়কে পুনরুজ্জীবিত করেছি। একটি হলো ঢাকা ফটক, আরেকটি হলো আসাম অভিযানের শেষ নিদর্শন এই কামান।
মেয়র ব্যারিস্টার শেখ তাপস বলেন, আমরা সারা বিশ্বের অনেক বড় বড় দেশ ঘুরি। অনেক কিছুই আমরা দেখি। আমরা যদি দুবাই, সিঙ্গাপুরের কথা বলি, তাহলে আপনারা দেখবেন অনেক বড় বড় অট্টালিকা, বড় বড় সড়ক, বড় বড় স্থাপনা। কিন্তু তার সবই নতুন। তারা হয়তো সাগরকে ভরাট করে নির্মাণ করছে। এরকম তারা অনেক কিছুই করতে পারবে। কিন্তু ৪০০ বছরের পুরনো ঢাকা ফটক সেসব এলাকায় পাওয়া যাবে না। এটাই হলো আমাদের ঐতিহ্যের জায়গা, আমাদের গর্বের জায়গা। সুতরাং ঢাকাকে যদি তার পূর্ণ বৈশিষ্ট্যে, পূর্ণ চরিত্রে ফিরিয়ে আনতে হয় তাহলে আমাদেরকে ঐতিহ্যকে ধারণ করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, আজকের এই সংস্কারকাজ করতে খুব বেশি বাজেটের প্রয়োজন হয়নি। শুধু প্রয়োজন হয়েছে ভালোবাসা, আন্তরিকতা ও ঐতিহ্যকে ধারণ করার। আমরা এই কাজটা ৪০০ বছর পর করলাম। আরও ৪০০ বছর এই কাজটা জীবিত ও অম্লান থাকবে। নতুন প্রজন্মের জন্য এটি স্মৃতি হিসেবে রয়ে যাবে। বহির্বিশ্ব থেকে পর্যটকেরা দেখবে। পর্যটকেরা ঘুরতে এসে অনেক কিছু পায় না। আমরা এখন ঐতিহ্যকে পুনরুজ্জীবিত করছি। এখন এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণ ঘুরতে পারবে, ঢাকা গেট ঘুরতে পারবে ও মরিয়ম কামান দেখতে পারবে। মেয়র শেখ তাপস এসময় লালকুঠি সংস্কার করা হচ্ছে এবং এ বছরের মধ্যে তা সকলের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হবে বলে জানান। এছাড়াও তিনি রুপলাল হাউস, বড় কাটরা ইত্যাদি ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলো সংস্কার ও সংরক্ষণের লক্ষ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কাছে হস্তান্তরের জন্য ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর ও ঢাকা জেলা প্রশাসনকে চিঠি দেয়া হয়েছে বলে জানান এবং সেগুলো হস্তান্তরে সকলের ভূমিকা কামনা করেন।
মেয়র বলেন, আমরা ঢাকা গেটে জনবল নিয়োজিত রাখব। সার্বক্ষণিক পরিষ্কার রাখা হবে। ময়লা-আবর্জনা, পোস্টার দিয়ে যাতে এই ঢাকা ফটকের পরিবেশ বিনষ্ট না করে। আমি সকলের কাছে সেই আহ্বান রাখলাম। শুধু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব নয়, সকল নাগরিকের দায়িত্ব হবে এটা পরিষ্কার রাখা। কেউ এখানে পোস্টার লাগালে, তাকে ধরিয়ে দেবেন ও তাকে জরিমানা করা হবে। আমরা তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেব।
এসময় ঢাকা-৮ আসনের সংসদ সদস্য ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, আজকের এই উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে মেয়র শেখ তাপস ঢাকার ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং বাংলাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্যকে রক্ষা করার একটি মহতী উদ্যোগ নিয়েছেন। সেজন্য তাকে অভিবাদন জানাই। মেয়র এমনই উদ্যোগ নেবেন, এটা খুবই স্বাভাবিক। মুনতাসীর মামুন স্যার বলেছেন, সেই স্বাভাবিক উদ্যোগ অনেক প্রচেষ্টা করেও তিনি কাউকে দিয়ে করাতে পারেন নাই। কিন্তু আমাদের বর্তমান মেয়র সেই স্বাভাবিক কাজটি দ্রুতগতিতে উদ্যোগ নিয়ে করেছেন। এটাই হলো স্বাভাবিকের ভেতরে অস্বাভাবিক কাজ । সুতরাং এই অস্বাভাবিক কাজটি আমাদের আগামীদিনের জন্য আরো করে যেতে হবে।
তিনি বলেন, ঢাকার ইতিহাস-ঐতিহ্যের সাথে আমাদের অনেক স্থাপনা এবং পত্নতাত্ত্বিক বিষয় জড়িত আছে। যেগুলো নিয়ে অনেক গবেষক, ইতিহাসবিদ কাজ করে যাচ্ছেন। আমার বিশ্বাস, দক্ষিণ সিটির মেয়র এই সকল বিষয়গুলোকে রক্ষা করবেন। ঐতিহ্যকে তুলে ধরার মধ্য দিয়ে তিনি বাঙালির চেতনা, মূল্যবোধ এবং ঐতিহ্যকে আরো জাগ্রত করতে সক্ষম হবেন।
অনুষ্ঠানে বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, আমরা উন্নয়ন মানে বুঝি, সবকিছু ভেঙে-চুরে নতুন করে নির্মাণ করা। কিন্তু ঢাকা ফটকের যে সংস্কার কাজ দেখলেন, এটা কিন্তু সম্পূর্ণ আলাদা কাজ। এটা নতুনভাবে নির্মাণ নয়। এটাকে অর্জিনিয়াল ফর্মে নিয়ে যাওয়া। এখন আমাদের মনে হয়েছে, সবার শিক্ষিত সার্টিফিকেট আছে কিন্তু সংস্কৃতি আলাদা জিনিস।
তিনি বলেন, শিক্ষা-সংস্কৃতির সমন্বয় না হলে এই ধরনের কাজে হাত দেওয়া যায় না। আমি খুবই আনন্দিত, আমরা যখন বর্তমান মেয়রকে বিষয়গুলো বলি তিনি তা যথেষ্ট আন্তরিকতার সাথে উদ্যোগ নিয়েছেন। আপনারা জানেন হয়তো, তিনি ঐতিহ্য সংরক্ষণে ঢাকা শহরকে ছয়টি (মূলত ৭টি) ঐতিহ্য বলয়ে ভাগ করেছেন। যেটার কাজ তিনি নর্থবুক হল থেকে শুরু করেছেন। প্রথম কাজ হিসেবে এই ফটককে বেছে নেওয়া হয় এবং আজকে এটা ঢাকা ফটক নামে উদ্বোধন করা হলো। যথেষ্ট আন্তরিক এবং সংস্কৃতিবান না হলে এই ধরনের কাজ করা খুবই দুরূহ।
অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মিজানুর রহমান শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন। এছাড়াও এশিয়া প্যাসিফিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবু সাঈদ এম আহমেদ এই সংস্কার কার্যক্রমের আদ্যোপান্ত নিয়ে পাওয়ার পয়েন্ট উপস্থাপনা করেন।
উল্লেখ্য, গত বছরের এপ্রিল থেকে শুরু হওয়া সংস্কারকাজটি শেষ হয় ৩০ ডিসেম্বর। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আহনাফ ট্রেডিংসের মাধ্যমে প্রায় ৮২ লাখ ৪০ হাজার টাকা ব্যয়ে ঐতিহাসিক ঢাকা ফটক সংস্কার করা হয়েছে। মেসার্স আহনাফ ট্রেডিংস এই সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে। এর মাধ্যমে ঢাকা ফটক তথা মীর জুমলার ফটককে পুরনো অবয়বে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। সংস্কার কাজে চুন, সুপারির কস, খয়ের, চিটাগুড় ও ইটের গুড়া এবং ফ্লোরের জন্য মধ্যপাড়া গ্রানাইট পাথরকুচি ব্যবহার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে ডিএসসিসি।
১৩ ঘন্টা ৩ মিনিট আগে
১৪ ঘন্টা ৪৭ মিনিট আগে
১৫ ঘন্টা ১২ মিনিট আগে
১৫ ঘন্টা ১৪ মিনিট আগে
১৬ ঘন্টা ২৪ মিনিট আগে
১৯ ঘন্টা ২৪ মিনিট আগে
২০ ঘন্টা ১৮ মিনিট আগে