ইসরায়েলে নতুন করে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে ইরান কাছের মানুষকে আলিঙ্গন করা কেন জরুরি? একদিনে আরও ২৬ জনের করোনা শনাক্ত, মৃত্যু ১ পাল্টা হামলার মুখে যাত্রী ছাড়াই বিদেশে বিমান সরিয়ে নিচ্ছে ইসরায়েল জাতীয় নির্বাচনের তারিখ নিয়ে সমাঝোতা একটি ইতিবাচক দিক : আতিকুর রহমান জামায়াতের ১নং ওয়ার্ড কর্তৃক সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত নাগেশ্বরীতে বাণিজ্যমেলা বন্ধের দাবিতে মানববন্ধন রায়গঞ্জে মাছ ধরতে গিয়ে পানিতে ডুবে ভাই বোনের মর্মান্তিক মৃত্যু সাতক্ষীরা কালিগঞ্জে আওয়ামী লীগ নেতা মোজাহার হোসেন কান্টু গ্রেপ্তার শ্রীপুরে দফায় দফায় হামলা ও ভাঙচুর, অর্ধশতাধিক বাড়িঘর ও দোকানপাটে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ লালপুরে জামায়াতের ঈদ পুনর্মিলনী অনুষ্ঠিত লালপুরে বিএনপির ঈদ পুনর্মিলনীতে জনতার ঢল! ঈশ্বরগঞ্জে সড়ক দুর্ঘটনায় ১ জন নিহত সাবেক সংরক্ষিত এমপি’র বাড়িতে যৌথবাহিনীর অভিযান: ইয়াবা-অস্ত্রসহ পুত্র আটক সুন্দরগঞ্জে জামায়াত কর্মী হত্যা মামলায় যুবলীগ নেতা আজম কারাগারে কালাইয়ে দুধর্ষ ডাকাতির ঘটনায় চিকন আলী নামে এক আন্তজেলা ডাকাত দলের সদস্য গ্রেপ্তার পাঁচ ব্যাংক মিলে হচ্ছে এক ব্যাংক, চাকরি হারাবেন না কর্মীরা নেতানিয়াহুর জন্য বিশ্ব আরও বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে’ গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হককে অবরুদ্ধের প্রতিবাদে পীরগাছায় মশাল মিছিল সড়ক দুর্ঘটনায় লালপুরের যুবকের মৃত্যু

আল্লামা শায়খ ফখরুদ্দীন (রহ) সাহেবের মত বড় মুহাদ্দিসের কাছে পড়তে পারা ছিলো আমার জীবনে শ্রেষ্ঠ নিয়ামতের অন্যতম

আল্লামা শায়খ ফখরুদ্দীন (রহ) সাহেবের মত বড় মুহাদ্দিসের কাছে পড়তে পারা ছিলো আমার জীবনে শ্রেষ্ঠ নিয়ামতের অন্যতম

ড.আব্দুস সালাম আজাদী

আমরা বাংলাদেশের খুব বড় বড় মুহাদ্দিসগণের কাছে পড়তে পারিনি। কামিলে উঠতেই মিঞা মুহাম্মাদ কাসেমী (রহ) সড়ক দূর্ঘটনায় শহীদ হলেন, খাতীব সাহেব শায়খ উবাইদুল্লাহ (রহ) রিটায়ার্ড করলেন, নিয়ায মাখদুম খুর্তানী হুজুর (রহ) চিরবিদায় নিলেন। এর মধ্যে আমরা কামিলে উঠলাম, এবং আমার পিতৃতুল্য প্রিন্সিপ্যাল মুহাম্মাদ জায়নুল আবেদীন সাহেব আমাদের দিয়েই তা’মিরুল মিল্লাতে কামিল খোলার সিদ্ধান্ত নিলেন। আব্বার চিন্তা ছিলো তা’মিরুল মিল্লাতে পড়ি, খরচ দেয়া লাগবে না; আউটস্ট্যান্ডিং ছাত্রদের জন্য জামাই আদর ছিলো ওখানে। তাছাড়া প্রিন্সিপ্যাল সাহেবের আদর, মুহাদ্দিস তুরাব আলী সাহেবের মায়া, ডঃ গিয়াস উদ্দিন সাহেবের মায়াবি আকর্ষণ এবং সব হুজুর ও স্যারগণের অজস্র ভালোবাসাসিক্ত ছিলো মিল্লাতের পরিবেশ। আমার প্রিয় উস্তায আরেক প্রিন্সিপ্যাল আবু উমায়ের গোলাম বারী সাহেবের এক ধরণের আদরের নির্দেশ ছিলো আমি যেন শর্ষিনা পড়ি। এর মাঝে আমার বন্ধু ও বড় ভাই রুহুল আমীন এর কথা ছিলো বাদ দেন তো, এখানেই আসেন, ঢাকা আলিয়াতেই পড়েন, শিখবেন জানবেন ইলমে হাদীস কারে কয়।  জীবনের সর্বপ্রথম ইস্তেখারা করলাম ঐবার, কোথায় পড়বো। আমার ইস্তেখারার কথা আমার উস্তায, মুরুব্বি, চাচা, পিএইচডির সুপারভাইজার, ও একান্ত আপনজন, যার বুদ্ধি, পরামর্শ ও নির্দেশনা আজ অবধি মাথার উপর ছায়া হয়ে আছে সেই ডঃ প্রফেসর মুহাম্মাদ সোলায়মান বললেনঃ ইস্তেখারা তো ভালো, চালায়ে যাও, বাস্তব ইস্তেখারাও কর। আলিয়াতে যাও আল্লামা ফখরুদ্দীন, মাওলানা আব্দুর রহীম ও মাওলানা সালাহুদ্দীন সাহেবের ক্লাশ গুলো দেখে সিদ্ধান্ত নাও।
ঢাকা আলীয়ায় গেলাম, শায়খ ফখরুদ্দীন সাহেবের সাথে বিকেলের আড্ডায় নিলেন বন্ধু আইনজীবী রুহুলআমীন ভাই, প্রিন্সিপ্যাল মুফিয ভাই ও প্রফেসর ডঃ মুঈন ভাই। কথা বল্লাম শায়খের সাথে, ঘন্টা খানেকের মত, জ্ঞানের এমন আড্ডা জীবনেও দেখিনি। আনন্দ হাসির গল্পের সাথে জীবনের চোখ খুলে দেয়ার অসম্ভব ধরণের শক্তি ছিলো শায়খ আল্লামাহ ফখরুদ্দীনের মধ্যে। রাতের ইস্তেখারার সাথে বাস্তব ইস্তেখারার মিল পেয়ে আলীয়াতে পড়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। ফরম উঠালাম ডেডলাইনের দিনেই, উঠালাম আমার ফরম, ডঃ কালামের জন্যও আরেকটা। ফরম জমা দেয়ার সময় কাগজ পত্র নেই কাছে, তা’মিরুল মিল্লাতের প্রিন্সিপ্যাল হুজুরের কাছে কাগজ চাওয়ার শক্তি আমার ছিলোনা। তার চোখের ভয়, ও অন্তরের ভালোবাসা আমাকে তার কাছ থেকে বিদায়ের কথা ভাবতেই দেয়নি। আমি আল্লামাহ ফখরুদ্দীন হুজুরের কাছে গেলাম। আমার সমস্যা বুঝালাম। তিনি আমার ফরম হাতে নিয়ে লিখলেন, দরখাস্তকারী একজন স্ট্যান্ড করা ছাত্র,তার সার্টিফিকেট ও অন্যান্য কাগজ পত্রের জন্য আমি জিম্মাদার। কাগজ পত্র ছাড়াই ফরম কবুল হলো। আল্লাহর রহমতে ডঃ কালাম ও আমার জোরাজুরিতে হোক বা ইস্তেখারার যন্ত্রণায় হোক, আমার জীবনে আবে-হায়াত হয়ে আলীয়ায় ভর্তি হলো। 'খ’ গ্রুপের ক্লাশ টিচার ছিলেন ফখরুদ্দীন হুজুর, সাহীহ বুখারী পড়াতেন, সাহীহ বুখারীর আরেকজন শায়খ ছিলেন মাওলানা ওজীহুদ্দিন সাহেব, সাহীহ মুসলিম পড়াতেন মাওলানা সালাহুদ্দীন সাহেব, সুনান নাসাঈ পড়াতেন শায়খ খায়রুল বাশার সাহেব, সুনান আবূ দাঊদ পড়তাম শায়খ মুহাম্মাদ কাসিমুদ্দীন সাহবের কাছে। শায়খ আব্দুর রাহীম পড়াতেন সুনান তিরমিযী। শায়খ মুকাদ্দাস আলী সাহেব ও শায়খ আব্দুল হক সাহেব বায়যাভী পড়াতেন। ইতিহাস পড়তাম আমরা ঢাকা আলিয়ার প্রিন্সিপ্যাল হুজুর শায়খ ইউনুস শিকদারের কাছে।
শায়খ ফখরুদ্দীন ছিলেন সমস্ত শিক্ষক গণের মধ্যে খুব ই ব্যতিক্রমী। তিনি সব বিষয়েরই পারদর্শী ছিলেন যুগপত। তাফসীর নিয়ে কথা বললে তিনি তাফসীর সমূহের ভেতরে নিয়ে যেতেন। তার কাছেই প্রথমে জানতে পেরেছি যমখশরীকে বাদ দিয়ে কুরআনের সাহিত্য বুঝা বাতুলতা। জেনেছি বায়যাভী কে বাদ দিয়ে কুরআনের গ্রামার ও বালাগাত শেখা ‘দিল্লী হনুয দুরআস্ত’ বা অসম্ভব। আধুনিক তাফসীর গুলো নিয়ে তিনি ভাবতেন বলে মনে হয়নি, তবে পুরাতন তাফসীর গুলোর কোনটার কি বৈশিষ্ট্য ছিলো তা তার নখ দর্পনে। তিনি হাদীস পড়াতেন, এবং এতে তার যে বৈশিষ্ট্য আমি দেখেছি তা অদ্যাবধি কারো মধ্যে পাইনি। তিনি সহীহ বুখারী পড়াতেন, কিন্তু ছয়টি হাদীস গ্রন্থ সামনে রাখতেন, একটা হাদীস পড়লে তার রিওয়ায়াতের সিলসিলার উপর লম্বা আলোচনা করতেন। মূল হাদীসের টেক্সটে কোন বেশি কম হলে কোন যায়গা থেকে এই বেশি কম টা হলো তা ইনি ইবনে হাজার আসকালানীর চাইতেও বেশি সুন্দর করে বুঝাতেন। সব চেয়ে ভালো লাগতো রাওয়ী বা বর্ণনাকারীদের মধ্যে একে অপরের রক্তের সম্পর্ক বা অন্যান্য সম্পর্কের মধ্যে। আব্দুল্লাহ ইউসুফ কা’নাবি কে নিয়ে মজা করতেন, ইমাম মালেকের সাথে তার সম্পর্কের বর্ণনা দিতেন। আমর ইবন শুয়াইবের হিফয নিয়ে ইতিহাস বলতেন, কোন হাদীস তার মাথার, আর কোন হাদীস তার লেখা থেকে বর্ণনা তা তিনি রেওয়ায়েতের শব্দ দেখেই বলে দিতে পারতেন। তিনি ইবনে লাহি’আর হাদীস কে নিয়ে অনেক বেশি সতর্ক হতেন, এই সময় তিনি ছয়টা গ্রন্থের কাছে যেতেন, মুতাবি’ আর শাওয়াহেদের জন্য। দিরায়াত বা হাদীসের মূল ভাষ্য বুঝার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন আমার দেখা মুহাদ্দিসগণের অন্যতম। তিনি দেওবন্দ সিলসিলার বেশ সমালোচক ছিলেন। যদিও আমার হাদীসের বেশীরভাগ সনদ দেওবন্দ এর মাধ্যমেই এসেছে, তিনি একটা সনদকে আমাদের হাইলাইট করতেন, যেটা দুইজন শায়খের মাধ্যমে আমাদের তিনি দিতেন, তা হলো মুফতি আমীমুল ইহসান (রহ) ও ইমাম যাফর আহমাদ উসমানী (রহ) এর সিলসিলাহ। দেওবন্দ সিলসিলার হাদীস অধ্যায়নের মূলসূত্র হতো ইমাম আবূ হানিফা (রহ) এর মাযহাব ভিত্তি করে। অর্থাৎ সহীহ হাদীস যত সহীহ হোক না কেন, তা মাযহাবের মানদণ্ডে বিচার করা হতো। মাযহাবের বাইরে গেলে তাকে হয়ত বাদ দিতে হত, অথবা ব্যাখ্যা করতে হত। কিন্তু তিনি ছিলেন এর অনেকটা বাইরে। তিনি বেশ কিছু মাসআলাতে সহীহ হাদীসকে প্রাধান্য দিয়েছেন, যদিও সে ব্যাপারে হানাফী মাযহাবের দ্বিমত আছে। মাগরিবের আযানের পর ইক্বামতের মাঝে দুই রাকাআত সুন্নাহ সংক্রান্ত হাদীসকে প্রাধান্য দিয়েছেন, যদিও হানাফী মাযহাবে এটা সুন্নাহ হিসেবে দেখানো হয়নি। হাদীসের দিরায়াতে যেয়ে তিনি বুদ্ধি-বৃত্তির আশ্রয় নিতেন। এক্ষেত্রে মনোবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান ও এমনকি আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞানের ও তিনি সাহায্য নিতেন। তিনিই আমার সর্বপ্রথম বাংলাদেশী উস্তায যিনি মাক্বাসিদের শারিয়া ও কাওয়াদে ফিক্বহিয়্যাহ এবং তারজীহ ইন্তেক্বাঈর ধারণা দেন। মাক্বাসিদে শারিয়ার সারকথা হলো দ্বীনের কোন হুকুম আহকামই মানব জাতির কল্যান সাধন ছাড়া আল্লাহ দেননি। এই ব্যাপারে তিনি শাহ ওয়ালিউল্লাহের ‘হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ’ খুব গভীরভাবে পড়েছেন, এবং সেখান থেকেই তার আলোচনা গুলো ঋদ্ধ করতেন। কেন এই নির্দেশ দেয়া হয়েছে, কেন ঐ নির্দেশ হয়েছে এর উত্তর গুলো সুন্দরভাবে দিতেন। তিনি ক্বাওয়াদে ফিকহিয়্যার অনুসৃত হাদীস গুলোকে নিয়ে গভীর স্টাডী করতেন, ক্বাওয়ায়েদে ফিক্বহিয়্যাহ গুলোর তুলনামূলক বেশ কিছু আলোচনাও তার কাছ থেকে শুনেছি, মুফতী আমীমুল ইহসানের (রহ) ক্বাওয়াদে ফিক্বহিয়্যাহ ও জাসসাসের গ্রন্থের সাথে তিনি ইমাম শাতেবীর (রহ) রেফরেন্স নিয়ে আসতেন। “আলফিকহ ‘আলা আলমাযাহিবিল আরবা’আহ” বইটা তিনি সব সময় তার হাতের কাছেই থাকতো। তার ব্যক্তিগত তিনটি ডায়েরি আমি ফটো কপি করি, সেখানে দেখেছি তিনি ঐ বইএর রিফারেন্স দিয়েছেন। কঠিন কঠিন মাসআলা নিয়ে যখন তারজীহ বা প্রাধান্য দিতেন তখন দলীলের আধিক্যকে মূল ধরে নয়, দলীলের শক্তির উপর তিনি ভর করতেন। যদিও তিনি হানাফী মাযহাবকে প্রাধান্য দিতেন, তবুও মাঝে মাঝে বলতেন, এই ব্যাপারে উমুক মাযহাবের মত টাও ভাল।
বুখারির ‘ইফক’ বা আয়িশার সিদ্দীকার (রা) বিরুদ্ধে অপবাদের হাদীস পড়ানোর সময়ে সায়্যিদুনা আলী (রা) এর ভূমিকা পড়াতে যেয়ে তিনি সমস্ত রেওয়ায়াত সামনে নিয়ে আসেন, ইতিহাসের সমস্ত ঘটনা গুলো আলোচনা করেন। এরপরে তিনি মনোবিজ্ঞানের জটিল বিষয় গুলো এমন ভাবে উল্লেখ করেন যাতে আমাদের কাছে ইফকের ঘটনা, জংগে জামালের পরিস্থিতিকে এবং আলী (রা) ও আয়িশা (রা) এর মাঝে ঘটে যাওয়া ভুল বুঝাবুঝি ও একে অপরের সম্মান বোধের ক্ষেত্রগুলোকে দিনের দেদীপ্যমান সূর্যের মত স্পষ্ট করে তুলেন।
তিনি আমাদের বলতেন, হাদীস গুলো হলো আমাদের নবীর (সা) সারাজীবনের দিনপঞ্জি, তিনি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কাজ করেছেন, কখনো সেই কাজ অন্য কাজের বিপরীত ও হয়ে যেত। কিন্তু সে ক্ষেত্রে ‘শানে উরূদ’ বা হাদীস টা বলার বা ঘটার কারণ জানা খুব জরুরী। যেমন আমাদের নবী (সা) দাঁড়িয়ে পেশাব করতে নিষেধ করেছেন। কিন্তু একবার তিনি দাঁড়িয়ে পেশাব ও করেছেন, কারণ সেখানে বসে পেশাব করলে মারাত্মক ময়লা তার কাপড় চোপড়ে লেগে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিলো। এখন এই ধরণের হাদীস গুলো আসা মানে হলো উম্মাতের কাজের সহজতা আনা। সময় বিশেষে দাঁড়াতে হতে পারে, কিন্তু স্বাভাবিক অবস্থায় নয়। তার বর্ণনাভংগী এমন ভাবে থাকতো আমরা অভিভূত হতাম।
ইতিহাসের উপর তার ছিলো ভালো দখল। বিশেষ করে সীরাতুন্নাবীতে তাঁর পা ছিলো খুব সুদৃঢ়। হাদীসের মেথোডোলজীকে তিনি সীরাহ অধ্যায়নের ও মূলনীতি হিসেবে দেখতেন। এটা ছিলো বাংলাদেশের জন্য একটা যুগান্তকারী। এই মেথোডোলজীর পূর্ণরূপ দেখেছি মদীনায় যেয়ে। বিশেষ করে আমাদের উস্তায প্রফেসর ডঃ আকরাম দ্বিয়া আল’উমারীর চেষ্টায় ও অন্যান্য আলিমদের লেখনীতে তা বের হয়েছে। সেটা হলো সীরাতের নামে গাল গল্পের আমদানী যে সীরাত গ্রন্থসমূহে করা হয়েছে সেগুলোকে কেটে ছেটে সহীহ হাদীসের আদলে নিয়ে আসা। তিনি তাই মাওয়াহেবে লাদুন্নিয়া, আশশেফা, শেফা আশশেফা ইত্যাদীর যুপকাষ্ঠ থেকে ছাড়ায়ে নিয়ে আমাদের কে দানাপুরীর আসাহহুস সিয়ার, সীরাতুল মুস্তাফা, সুলাইমান নাদভীর সীরাতুন্নাবী ইত্যাদির প্রাংগনে নিয়ে আসেন। তিনি ‘হায়াতুস সাহাবা’ গ্রন্থের খুব প্রশংসা করতেন এবং মুফতি তাক্বী উসমানীর রেফারেন্স দিতেন। তারই পরামর্শে আমি ফাতহুল মুলহিম এবং তাকমিলাহ কিনি সাহীহ মুসলিম বুঝার জন্য।
তিনি তার ছাত্র দের ভীষণ ভালোবাসতেন, তাদেরকে আলাদা সময় দিতেন। তিনি ব্যাচ পড়াতেন এবং ছাত্ররা যা দিতে পারতো তাতে কোনদিন কথা বলতেন না। টাকা তাকে হাতে হাতে দেয়া যেতোনা। ছাত্ররা টাকা উঠায়ে তাকে দিতেন, কে কত দিলো, তা নিয়ে কোনদিন মাথা ঘামাতে দেখিনি। তিনি ভালো খেতেন, এবং খাওয়াতেন। তার কেনা চা, নিরব হোটেল থেকে আনা সুন্দর খাদ্য আমাদের ও খাইতে হতো। তিনি প্রচুর পান খেতেন, এবং খুব আয়েশের সাথেই তা খেতেন। আমাদের সময়ে আমি ছিলাম তার পান কেনার কর্মচারী। পলাশী বাজার থেকে বাছাই করে বড় বড় পান আনতে হতো তার জন্য। কতবার চেষ্টা করেছি আমার পকেট থেকে কেনার, কিন্তু তা তিনি করতে দেননি। ছাত্রদেরকে ভালোবাসতেন অনেক বেশি। আলিয়ায় পড়তে যেয়ে আমার অর্থ সংকট দেখা দিতো, তিনি বুঝতে পারতেন, এবং বলতেন পকেটে টাকা না থাকলে আমাকে বলবে, আবার পকেটে এলে দিয়ে দেবে। আমার চোখে পানি আসতো, তিনি কিভাবে বুঝতেন আমার কাছে টাকা নেই তা আল্লাহই ভালো জানেন।
তিনি খুব সাহসী ছিলেন। রাজনৈতিক দোলাচালকে ডরাতেন না তিনি। রাজনীতি তার চর্চার বিষয় ছিলোনা কোনদিন, কিন্তু রেডিও একটা নিয়ে সব সময় দেশ বিদেশের খবর রাখতেন। আলীয়া-ছাত্রাবাস ছিলো লীগ, দল ও শিবিরের হাতে। ওখানে কর্তৃপক্ষের কোন ক্ষমতা ছিলোনা। ফলে আমাদের মত অরাজনৈতিক ছাত্রদের সমস্যা হতো। আমরা তা’মিরুল মিল্লাতের ছাত্র ও স্ট্যান্ড করা ছাত্র বলে শিবিরের কাছেও সহানভূতি পেতে ব্যর্থ হই। অথচ আমার রোল নাম্বার ছিলো দুই, সেই সুবাদে প্রথম পাঁচজন শ্রেষ্ট ছাত্রদের সীট তো এমনিতেই হবার কথা ছিলো। আমাদের এই দূর্দশা দেখে আমাদের শায়খ ফখরুদ্দীন নেন মারাত্মক এক পদক্ষেপ। পুলিশ দিয়ে হল ভ্যাকান্ট করিয়ে মেধার ভিত্তিতে সীট বরাদ্দ করান। আলহামদুলিল্লাহ, এমন পরিবেশ করা হয় যে আলীয়া ছাত্রাবাসের কোন রূমটা আমার পছন্দ তা আমি নিজেই বেছে নেয়ার মত পরিবেশ পাই। আমাদের শায়খের এই ঋণ কোনদিন শোধ করতে পারবোনা।
তার এই সাহসী পদক্ষেপ তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। আলীয়া মাদ্রাসায় মেধার ভিত্তিতে সীট দেয়া মানে মাদ্রাসায় পড়ুয়া অথচ লীগ করে বা দল করে তাদের সীট কমে যাওয়া। আর অছাত্রদের বের হয়ে যাওয়া। ফলে শিবির খুব ভালো অবস্থানে চলে যায়। এটা ঐ সংগঠন গুলো মেনে নিতে পারেনি। ফলে তারা শায়খের উপর ভীষণ ক্ষেপে যায়। এর সাথে যুক্ত হয় আমাদের আরো কিছু উস্তাযদের নোংরা রাজনীতি। ফখরুদ্দীন সাহেবের কাছেই থাকে ছাত্রদের ভীড়, তার কাছে ব্যাচে পড়ে প্রায় শতেকের উপর ছাত্র। ইনকাম হতো সেই সময়ে যে কোন ভালো চাকুরিজীবীর চেয়ে ঢের গুণ। কাজেই রোষ, ক্ষোভ, হিংসা ও বিদ্বেষের শিকার হয়ে পড়েন এই অকুতোভয় শায়খুল হাদীস। তিনি কারো সাথে কম্প্রোমাইজ করেন নি, কোন রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তি করেননি, রাতের আঁধারে কারো কাছে সাহায্য চান নি, যা ই করতেন তা জায়নামাজে দাঁড়িয়ে, বসে বা সাজাদাতেই করতেন দেখেছি। যে শিবির তার কারণে বেশি লাভবান হয়েছে, তিনি তাদের কাছেও সেই সংগীন সময়ে সাহায্য চাননি। যদিও শিবির তার পাশে থেকেছে শেষ সময় পর্যন্তও। ফলে নোংরামির এক ওয়েভ আমি আলীয়ার প্রতিটি যায়গায় তখন দেখেছি। গন্ডোগোল হয়েছে, ছাত্রদলের হাতে আমাদের এই শ্রেষ্ঠ শিক্ষক মার ও খেয়েছেন, এবং এই দলের কোন একনেতার বাবার হাতেও তিনি নিগৃহিত হয়েছেন। সাথে সাথে ঢাকা আলীয়া থেকে তাঁকে জোর করে সিলেট আলীয়ায় বদলীও করা হয় অত্যন্ত নিকৃষ্ট পথে। আমাদের কামিল পরীক্ষার একটা পেপার ও তার উপর রাগ করে এমন কঠিন করে প্রশ্ন করা হয় যাতে করে সেবার কামিল পাসের হার খুব মারত্মক ভাবে কমে যায়। গোটা আলীয়া মাদ্রাসায় কামিল হাদীসে সেবার মাত্র দুই তিনজন ছাত্র প্রথম বিভাগ পায়। অবশ্য ডঃ কালাম স্মরণীয় কালের সেরা নাম্বার পেয়ে বাংলাদেশে প্রথম শ্রেনীতে প্রথম হয়ে আলীয়ার মুখ উজ্জ্বল করে দেন।
উনার বিদায়ের দিনে আমরা জিনিষ পত্র গুছিয়ে দিয়েছি রাতে। আমরা যখন ফিরে যাচ্ছি, তিনি আমাকে বললেনঃ আব্দুস সালাম, তোমার সাথে ব্যক্তিগত কিছু কথা আছে। কাল তুমি আমার সাথে কমলাপুর রেল স্টেশন যাবে, চিটাগাংগামী ট্রেইনে আমাকে তুলে দিয়ে আসবে, ওখানে দুই এক দিন থেকে আমি সিলেটে যোগদান করবো। আমি কেঁদে ফেলেছিলাম আনন্দ, বেদনায় ও শায়খের মুখের দিকে তাকিয়ে। সকালে উনার ব্যাগ নিয়ে রিকশার পাশে বসলাম, ফজরের পর রিক্সায় ঢাকায় চলার আনন্দ ছিলো সে সময় অনেক। ২০/২৫ মিনিট লাগতো আলীয়া থেকে কমলাপুর যেতে।
রিক্সা চলতে শুরু করলেই তিনি বললেনঃ যশোরের একটা মাদ্রাসা থেকে হেড মুহাদ্দিস হিসেবে একজন ভালো শিক্ষক চেয়েছে, প্রিন্সিপ্যাল আমার ছাত্র। আমার কাছে এসেছিলো। আমি তোমার কথা বলেছি। আমি চাই তুমি ওখানে যাও। শুনলাম। আবার কাঁদলাম। একজন ছাত্রের জন্য এত মুহাব্বাত, এর কি আমি যোগ্য, আল্লাহ!! আমি আমার পকেট থেকে একটা কাগজ বের করলাম, বললাম, হুজুর, এই কাগজ টা তিনদিন আগে পেয়েছি। আপনাকে দেখাইনি কারণ অতো বিষাদের মাঝে আনন্দের কিছু দেই কি করে। তবে এটা একটু পড়েন, এরপর আপনি যা বলবেন সেইটাই করবো ইনশাআল্লাহ। তিনি কাগজ নিলেন, পড়লেন, চশমার কাঁচের নিচ দিয়ে হাত ঢুকায়ে চোখের পানি মুছলেন। বললেনঃ আল্লাহর কাছে তোমার জন্য বেশ কিছু ব্যাপারে দুয়া করেছি। কবুল হবে ভাবিনি, যদি জানতাম ঐ সময় আমার দুয়াটা কবুল হচ্ছে, তাহলে আমার জন্যও একটা দুয়া করতাম। না, যশোর থাক, তুমি রিয়াদ বিশ্ববিদ্যালয়ে যাও, তবে ওখানে যেয়ে প্রথম উমরাহ করে আমার জন্য দুয়া করবা।
আমার অপবিত্র বুকে ঐ জান্নাতি মুহাদ্দিসের বুকের পরশ লাগলো, দুই জনের টলমলে চোখের পানি নিষ্কলুষ ভালোবাসার জানান দিলো। ট্রেইনে তড়িঘড়ি করে উঠে সীট নিলেন, হাত উঁচু করে ঠোট জোড়া কষ্ট করে ফাক করলেন, এই বুড়ো বয়সে এখনো বুঝিনা সেটা কি হাসির ছিলো, নাকি কান্নার ছিলো।
১৯৮৯ সালের আগস্ট, তারপরে আমিও এগিয়েছি, দূর থেকে আমার উস্তাযের সুনাম শুনে শুনে গর্ব করেছি, ক্রমান্বয়ে উন্নতি দেখে আল্লাহর বন্ধুত্বের ছাপ বুঝেছি। সিলেট আলীয়ার প্রিন্সিপ্যাল করেই আল্লাহ তাকে উঠিয়ে নিয়েছেন। চুনতি হাকিমিয়্যাহতে তিনি আমৃত্যু হাদীস পড়িয়েছেন। আল্লাহ আমার এই শায়খকে শ্রেষ্ঠ অলীদের সাথেই জান্নাতে স্থান দিন।



লেখক: ইসলামী চিন্তাবিদ ও গবেষক।
পরিচালক, কিউএনএস একাডেমী, যুক্তরাজ্য। 

আরও খবর