প্রফেসর ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া,
প্রফেসর আল্লামা ফখরুদ্দীন রাহিমাহুল্লাহ, যাঁর মাধ্যমে আমার ইলমে হাদীসের জ্ঞানচর্চার সূত্রপাত। যাঁর ইলমের কথা বলতে গেলে আমার জিহ্বা আড়ষ্ট হয়ে যায়, যার ভালোবাসার কথা মনে হলেই অন্তরে আনন্দের ঢেউ বয়ে যায়। যার আন্তরিকতার কথা আমি কোনোদিন বলে শেষ করতে পারবো না। আসলে কিছু জিনিস আছে, যা কখনো ভাষায় প্রকাশ করা যায় না, শুধু অন্তরের অন্তঃস্থলে নিরবিচ্ছিন্নভাবে প্রেরণা যোগায় ও দো‘আর সঞ্চার করে। আর তাহচ্ছে আমার শাইখ, আমার মুরশিদ, আমার হাদীসের উস্তাদ, আমার জীবনের মোড় পরিবর্তনকারী, জনাব আল্লামা ফখরুদ্দীন রাহিমাহুল্লাহ। যাঁর নেক দো‘আ আমি আমার জীবনে সর্বত্র কাজে লাগিয়েছি, আজও সেটার প্রভাব আমার জীবনেরে প্রতিটি পরতে পরতে অনুভব করি।
১৯৮৬ সালে আমি নিজ গ্রাম ধনুসাড়া ইসলামিয়া মাদরাসা থেকে ফাযিল পাশ করি। আমার আব্বা মাওলানা মুহাম্মাদ ছিদ্দিকুর রহমান উক্ত মাদরাসার তখন অধ্যক্ষ। তাঁর হাতে গড়া হাজারো ছাত্রের মধ্যে আমি একজন। সেখানে আর পড়ার সুযোগ না থাকায় আমাকে এ প্রথম বাড়ির বের হতে হলো। উদ্দেশ্য ছিল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বো, আরো উদ্দেশ্য কোনো ভালো কামিল মাদরাসায় বাকী পড়া শেষ করবো। গায়ে ছিল শর্ষিনার নিসফে সাক্ব জামা।
১৯৮৬ সালের শেষের দিকে কোনো এক পড়ন্ত বিকেলে তৎকালীন বাংলাদেশের মাদরাসা শিক্ষার শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ মাদরাসা-ই-আলীয়ায় এসে প্রথমে ভর্তি ফরম পূরণ করে জমা দিই। পরের দিন সকাল বেলা ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করি। সে পরীক্ষা দিতে যাওয়ার সময় এক আশ্চর্যজনক ঘটনা ঘটে। মাদরাসা আলীয়ার ছোট গেট দিয়ে ঢুকছি, এমন সময় একজন বললো, “ওই তুই ছিদ্দিকের পুত নিরে?” আমি তো আশ্চর্য, এ লোক কীভাবে আব্বাকে চিনল? বললাম, জী, আপনি কার কথা বলছেন? বললেন, তোর বাপের নাম কী? আমি বললাম, মাওলানা মুহাম্মাদ ছিদ্দিকুর রহমান। তিনি বললেন, “আমি দেখেই বুঝছি, তুই ছিদ্দিকের ছেলে। তোর চেহারার সাথে অনেক মিল আছে। তোর বাপরে সালাম বলিস। আর বলিস আমি প্রফেসর মোতাহার হোসেন। ছিদ্দিক আর আমি একসাথে পড়েছি শর্ষিনায়।
যথারীতি পরীক্ষা দিলাম, ভালোই নম্বর পেলাম। ভর্তি হলাম। ভর্তি পরীক্ষার নম্বরের উপর সীট বণ্টন করা হলো। সীটও পেয়ে গেলাম। ক্লাস করতে আরম্ভ করলাম। আমাদের ক্লাস টিচার হলেন, মাওলানা আব্দুর রহীম (ইমাম সাহেব হুযুর)। কিন্তু তখনই শুনতে পাচ্ছিলাম যে, মাদরাসা-ই-আলীয়াতে দুই বিখ্যাত শিক্ষক আছেন, একজন হচ্ছেন, মাওলানা ফখরুদ্দীন সাহেব, যিনি উর্দুতে তাকরীর করেন, আরেকজন হচ্ছেন মাওলানা ওয়াজীহুদ্দীন সাহেব। যিনি হাদীসের ইলমুর রিজাল সম্পর্কে অনন্য জ্ঞানের অধিকারী। অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই প্রথম বর্ষের পড়া শেষ হয়ে যায়।
দ্বিতীয় বর্ষের শুরুতেই আমরা জানতে পারলাম যে, আমাদের ক্লাস টিচার হচ্ছেন ফখরুদ্দীন হুযুর। শুনে অত্যন্ত ভালো লাগলো। হুজুর উর্দুতে তাকরীর করতেন। মাঝে মধ্যে উর্দুতে সুন্দর করে ‘লতীফা’ (ছোটগল্প) বলতেন। আবার হেসে বলতেন, ‘এটা তোমাদের আব্দুল লতীফ হুযুরের মুওয়ান্নাস না’। আমরা হুযুরের অসাধারণ সে গল্পগুলো আজও মাঝে মধ্যে স্মরণ করি।
ক্লাসে সাধারণত অল্প কয়েকজন ইবারত পড়তো, হয়, আমার দোস্ত মাওলানা মুফিজুর রহমান, (বর্তমান প্রিন্সিপাল, লাউড়ী আলিয়া মাদরাসা) অথবা আমি পড়তাম, কখনো কখনো কাজী সিরাজ পড়তো, কখনো (মাদ্রাসার আলীয়ার বিশেষ ছাত্র) ময়নুল হক পড়তো (বর্তমানে প্রফেসর, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া), আবার কখনো কখনো হারূন তা পড়তো। উস্তাদের তাকরীর লেখার ক্ষেত্রে আমি, ময়নুল হক আর মুফিজ অগ্রণী থাকতাম।
একদিন কোনো এক কাজে আমার দোস্ত মুফিজুর রহমান ক্লাসে অনুপস্থিত। আমি সেদিনের দারসের তাকরীরটি লিখলাম। রাতে রুমে এসে মুফিজ সেই লিখা খাতাটি নিয়ে যায়। পরদিন আমাকে বললো, আপনাকে তো ফখরুদ্দীন হুজুর স্মরণ করেছে, বলতে তার সেখানে যেতে। ভয় পেয়ে গেলাম, বললাম, কেন? বললেন, ভয় নেই। খাতার অনেক কথা বুঝা যাচ্ছে না তাই আমি হুজুরের কাছে নিয়ে গেলাম, হুজুর বললেন, কার লেখা? আমি বললাম, আপনার কথা, হুজুর খুশি হলেন এবং আপনাকে তার একান্ত দারসে থাকতে বলেছেন।
একান্ত দারসের সাথে আমার পরিচিতি ছিল না। পরে জানলাম, কাজী সিরাজ, মুফিজ, হারূন, আরও কয়েকজন হুজুরের সাথে বিশেষভাবে বুখারী পড়ছেন। সেটার সুযোগ সবাই পায় না। যাদেরকে হুজুর ভালোবাসেন তাদেরকেই শুধু পড়ান।
পরে বুঝতে পেরেছি হুজুর কেন আমাকে ডেকে নিলেন। কারণ উর্দু জানা থাকা সত্ত্বেও হুজুর উর্দুতে তাকরীর করলেও আমি সেটা উর্দুতে না লিখে সাথে সাথে আরবীতেই লিখে নিতাম। আমার দোস্তের হাতে আরবীতে তাকরীর লেখা দেখে হুজুর খুশী হয়েছিলেন তাই ডেকে নিয়েছিলেন। এটা একান্তই আল্লাহর রহমত ও ফযল, আসলে উস্তাদদের নেক নজর ও দো‘আ না থাকলে মানুষ কখনও শিক্ষায় ভালো করতে পারে না।
সেই থেকে হুজুরের বাসায় আসা যাওয়া করতাম। তিনি তখন খাজে দেওয়ান রোড বা উর্দু গির্দা রোডের ছোট একটি রুমে অবস্থান করতেন। সেখানে আমরা আলাদা করে সহীহ বুখারীর তাকরীর শুনতাম। শুধু যে তাকরীর শুনতাম তা নয় সেটা আমাদের বৈকালিক আসর ছিল। সেখানে না গেলে আমাদের একটুও ভালো লাগতো না। আমার বন্ধুরা দু’ একদিন না গেলেও আমি আর দোস্ত মুফিজ কখনো যাওয়া বাদ দিতাম না।
একদিনের ঘটনা বলি, আমরা গিয়ে দেখলাম, কাজী সিরাজ নাই, হারূন বললো, স্যার কাজী সিরাজ অসুস্থ। পরের দিন আবার হারূন নাই, কাজী সিরাজ বললো, স্যার হারূন অসুস্থ। হুজুর হাঁসলেন এবং বললেন, ‘মান তোরা কাযী গুওয়াম তো মোরা হাজী বগু’। অর্থাৎ তোমরা একে অপরের জন্য ওযর নেয়ার বুদ্ধি করেছ।
কুরআনের আয়াতের দলীল দেয়ার ক্ষেত্রে হুজুর মাঝে মধ্যে ছাত্রদের জিজ্ঞাসা করতেন। খুব কম ছাত্রই সময়মত আয়াতটি উপস্থিত করতে পারতো। কিন্তু ছোটকাল থেকেই প্রতি আব্বাজানের নির্দেশে সকাল বেলায় কুরআন পড়ার বাধ্য-বাধকতা থাকায় অধিকাংশ আয়াত আমার মুখেই থাকতো। তাই হুজুর জিজ্ঞাসা করার সাথে সাথে উত্তর দিতে সক্ষম হতাম, যেখানে হাফেয সাহেবদের সময় লাগতো। হুজুর একদিন রসিকতা করে বললেন, ‘হাফেযের বাপ’। আমি মনে করি হুযুরের দোআ কাজে লেগেছে আল্লাহ আমাকে চার হাফেযের পিতা হওয়ার তৌফিক দিয়েছেন।
মাদরাসা আলীয়া পড়া অবস্থায় একবার ইমাম সাহেব হুযুর অসুস্থ হয়ে পড়েন। ইমাম সাহেব হুযুরের রুমে সাদেকুল্লাহ (মুফতি সাহেব) হুযুরও থাকতেন। সাদেকুল্লাহ হুযুর একসময় আমাদের ধনুসাড়া মাদরাসায় কিছুদিন ক্লাস নিয়েছিলেন। সেজন্য তিনিও আব্বাকে ভালো করেই জানতেন। ইতোমধ্যে আব্বাও ঢাকায় তাঁর কাজে আসলেন। আমি ইমাম সাহেব হুযুর ও সাদেকুল্লাহ হুযুরের কথা জানালাম। তিনি দেখতে গেলেন। আর সেখানে তখনই ফখরুদ্দীন হুযুর ইমাম সাহেব হুযুরকে দেখতে এসেছিলেন। ফলে ইমাম সাহেব হুযুরের রুম আলেমগণের মিলন-মেলায় পরিণত হয়। আব্বার সাথে ফখরুদ্দীন হুযুরের সেখানেই পরিচয় হয়। এরপর হুযুর মাঝে মধ্যেই আব্বার কথা জিজ্ঞেস করতেন।
একবার ছাত্র রাজনীতির কারণে মাদরাসা ই আলীয়া অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। হুযুরকে বললাম, হুযুর বাড়ী যেতে চাচ্ছি। হুযুর বললেন, আমিও যাব, ‘আপনি আমার সাথে যাবেন, আপনারে পথে নামিয়ে দিব।’ (হুযুর নিজ শরাফতের কারণে ‘আপনি’ করে বলতেন) হুযুরের সাথে সফর করার আনন্দই ছিল আলাদা। কত ইলমী বিষয় যে আলোচনা করলেন তা বলে শেষ করতে পারবো না। পথিমধ্যে চৌদ্দগ্রামে আমি নেমে নেমে গেলাম, মন পড়ে রইলো হুযুরের সান্নিধ্যের আশায়।
দীর্ঘ বন্ধের পর মাদরাসা আলীয়া খুললো, হুজুর একদিন ডেকে বললেন, আপনি কি চান না মাদরাসা ই আলীয়ার বৃত্তি পেতে? আমি বললাম, হুযুর কীভাবে? হুযুর বললেন, ভালো ছাত্রদের জন্য মাদরাসা আলীয়ায় বৃত্তির ব্যবস্থা রয়েছে। আপনাদের প্রিন্সিপ্যালকে বলেছি যেন ব্যবস্থা করে দেয়, আপনি একটি ফরম পূরণ করে জমা দেন। তারপর সে বৃত্তির ব্যবস্থা হয়েছিল। এটাও হুযুরের নেক নজর ও দো‘আর কারণে সম্ভব হয়েছিল।
এর মধ্যে সিদ্ধান্ত হলো যে, এভাবে মাদরাসা ই আলীয়ার শিক্ষকরা বাইরে থাকলে তাদের নিরাপত্তা থাকে না, তাই তাঁকে ভিতরে আনার ব্যবস্থা করা হলো। তাঁকে মাদরাসা ই আলীয়ার একটি বড় রুমে রাখা হলো। এতে আমাদের আরও বেশি সুবিধা হলো। প্রতিদিন হুযুরের কাছে বিকাল বেলা বসে থাকা বেড়ে গেল। হুযুর দুধ চা খুব পছন্দ করতেন। পানেরও এক বিশেষ প্রকরণ পছন্দ করতেন। হুযুরের দুধ চা যেখান সেখান থেকে আনলেই হতো না, যেখানে দুধ অনবরত গরম হচ্ছে, উর্দু গির্দা রোডের শেষ মাথায় সেখান থেকে ফ্লাক্সে করে নিয়ে আসতাম। যদি কোনো দিন কাঙ্ক্ষিত মানের চা না হতো, হুযুর বুঝতেন যে, চা তার সঠিক জায়গা থেকে আনা হয়নি। তখন তিনি বলতেন, যকরিয়া বা মফিয নিয়ে আসুক, আপনারা দোকান চিনেন না। আর পান তা তো আমি কোনোদিনই চিনতে পারতাম না, এটা মফিয খুব ভালো জানত। পান বাঁকা করলে শব্দ না হলে সে পান কেনা যাবে না। সেটা তিনি প্রায়শই বলতেন।
তারপর আমাদের পরীক্ষা হয়ে গেল। ভাইভা পরীক্ষা নেয়ার জন্য তখন আমাদের মাদরাসা-ই আলীয়ায় আসতেন শর্ষিনা আলীয়ার অধ্যক্ষ মাওলানা শরীফ মুহাম্মাদ আব্দুল কাদের। তিনি আমাদের ভাইভা পারফরমেন্সে খুশী হয়ে ফখরুদ্দীন হুজুরের কাছে বললেন, এ কয়েকজনকে আমার ঢাকা নেসারিয়া মাদরাসায় প্রয়োজন। হুজুর আমাদের সাথে শেয়ার করলেন। আমি বললাম, হুযুর এখনো পড়ালেখা শেষ করিনি। তবে আব্বাকে জিজ্ঞেস করব। হুযুর যা বুঝার বুঝে নিলেন।
আমি ৮-৮-৮৮ তারিখে মাদরাসা আলীয়ার ২৪১ নং কক্ষ ছেড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলের ২২৩ নং কক্ষে আমার নামে বরাদ্দ করা সিটে উঠে পড়ি। কারণ তখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবী বিভাগের ছাত্র। সেখানে থাকা অবস্থায় আমাদের কামিল পরীক্ষার রেজাল্ট বের হলো। আল্লাহর খাস রহমতে আমি ১৯৮৮ সালে কামিলে সম্মিলিত মেধাতালিকায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হলাম। তখনকার সময় যারা কামিলে প্রথম হতো তাদের নাম জাতীয় রেডিও, টিভিতে ঘোষণা করা হতো। রেজাল্ট শোনার পর হুযুরের সাথে সাক্ষাৎ করতে গেলাম, তখন ৮৮ এর বন্যা চলছিল। মাদরাসা ই আলীয়ায় বন্যা দূর্গতরা আশ্রয় নিয়েছে। মানুষের ভীঢ় ঠেলে কোনো রকমে হুযুরের রুমে প্রবেশ করলাম। হুযুর খুশী হলেন। অন্যান্য সংবাদ আলোচনার পর বললাম,
আমি হাদীসের সনদ পেতে আগ্রহী। হুজুর অত্যন্ত আনন্দিতচিত্তে বললেন, যান, এ বইটি ফটোষ্টেট করে নিয়ে আসেন। তাকিয়ে দেখলাম, তার নাম মিন্নাতুল বারী। তাতে বাংলার যমীনেরে গর্ব বায়তুল মুকাররাম মসজিদের খতীব মুফতী আমীমুল ইহসান রাহিমাহুল্লাহর সনদের গ্রন্থ। যাতে তিনি যেসব উস্তাদ থেকে বিভিন্ন গ্রন্থের সনদ লাভ করেছেন সেটা একত্রিত করেছেন।
ফটোষ্টেট করে আনার পর হুজুর নিজে তার নিচের অংশে তাঁর সনদসহ আমাকে সে গ্রন্থে উল্লেখিত সকল সনদের ইজাযাহ প্রদান করেন। জীবনে প্রথম কিতাবের সনদ লাভ করি। যা আমাকে আমার ইলমের মূল শ্রোতধারায় সংযুক্ত করেছে।
তারপর হঠাৎ করে আল্লাহ তা‘আলা আমাকে মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য কবুল করেন। সেখানকার পাঠে ও পড়ালেখায় সবসময় আমরা যারা মাদরাসা-ই-আলীয়ায় পড়েছি, আমি, আমার অনুজ ড. আবুল কালাম আযাদ, ড. আব্দুস সালাম আযাদী আমরা যখনই কোথাও ইলমী কোন মজলিসে বা খাবার কোনো টেবিলে বিভিন্ন বিষয় আলোচনা করতাম তখনই কথায় কথায় আমার প্রিয় উস্তাদজীর কথা স্মরণ করতাম। বিশেষ করে উস্তাদজী যেসব উদাহরণ দিতেন সেগুলো আজও যেন আমাদের চোখের সামনে চিরভাস্বর হয়ে আছে।
মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থাকাকালীন সময়ের শেষের দিকে থিসিস নিয়ে ব্যস্ত থাকায় অনেক বছর উস্তাদজীর সাথে দেখা-সাক্ষাৎ হয়নি। কিন্তু সর্বদা হাদীসের ইলমের কথা কোথাও আলোচনা হলেই তাঁর কথা এসেই যেত। আর যদি ঢাকা আলীয়া বা সিলেট আলীয়ার তাঁর কোনো ছাত্রেরে সাক্ষাৎ হয়ে যেতো তাহলে তো আর কথাই নেই। উস্তাদজীর আলোচনাই তখন আমাদের সকলের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে যেতো।
মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচ.ডি ডিগ্রী অর্জনের পর দেশে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় কুষ্টিয়ায় চাকুরী নিই। তখন বেশ কয়েকবছর বাংলাদেশের সরকারী মাদ্রাসাগুলো আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন থাকার সুবাদে বিভিন্ন জায়গায় কামিলের ভাইভা পরীক্ষা নিতে আমাদেরকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন কামিল মাদরাসায় পাঠাতেন। তেমনি এক ভাইভায় আমাকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ চট্টগ্রাম সুবহানিয়া আলীয়া মাদরাসায় পাঠান। সেখানে যাওয়ার তার প্রিন্সিপ্যাল মাওলানা হারূন সাহেবসহ ভাইভা নিচ্ছিলাম, সনদ ও মতনের কথা বলতে আমার উস্তাদজীর কথা এসে পড়ে। তখন আমাকে বললেন, আমিও শাইখের ছাত্র। তাৎক্ষনিক প্রস্তাব দিলাম উস্তাদজীর সাথে দেখা করার।
ভাইভা শেষ করার পর রাত্রিতেই চন্দনাইশের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম। যেতে যেতে উস্তাদজীর চেহারা শুধু ভেসে আসছিল, এখন জানি কেমন হয়ে গেছেন, আমাকে চিনবেন কি না? ইত্যাদি হাজারো চিন্তা করতে করতে রাত ৯টায় মুহতারাম উস্তাদজীর বাসার সামনে উপস্থিত হলাম। উস্তাদজীর ভাতিজা ও জামাতা আমাদেরকে যথাযথ সম্মান করে উস্তাদজীর কাছে নিয়ে গেলেন। আমার উস্তাদজী আমাকে একটুও ভুলেননি। এমনকি আমাদের সাথীদের কথাও স্মরণ করলেন, তাদের মাঝে কে কোথায় কী কাজে লিপ্ত তাও শুনলেন।
তারপর উস্তাদজী ইলমী আলোচনা শুরু করে দিলেন। মন দিয়ে শুনছিলাম আর মনে হচ্ছিল এরকম কিংবদন্তী আলেমকে আমার দেশ কদর করে না। তিনি জানালেন যে, অবসর নেয়ার পর চুনতি হাকিমিয়া আলীয়া মাদরাসায় মুহাদ্দিস হিসাবে পড়াচ্ছেন। তারপর হাদীসের এমন সব লাত্বায়িফুল ইসনাদ বর্ণনা করলেন, যা আমাকে আমার মাদরাসা আলীয়া জীবনে উস্তাদজীর তাক্বরীরের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিলেন। আলোচনা পিন-পতন নীরবতায় চলছিল, উস্তাদজী তাঁর জ্ঞানের অংশ আমাদের দিয়ে ধন্য করছিলেন আর আমরা তা শোনার জন্য এতই নিমগ্ন ছিলাম যে, হঠাৎ ঘর থেকে তাগাদা আসলো আমাদেরকে মেহমানদারী করাবেন, আমরা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি রাতের অর্ধেক গড়িয়ে এখন প্রায় ১টা বেজে গেছে। আমরা তখন উস্তাদজীর স্বাস্থের কথা চিন্তা করে তাড়াতাড়ি চলে আসার চিন্তা করলাম, দেরী হওয়ার জন্য উযর পেশ করলাম। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে উস্তাদজীর ভালোবাসায় শিক্ত শব্দ ‘আমার যকরিয়া আসছে, আজকে আমার অসুবিধা হবে না’। আল্লাহ আপনার দরবারে কায়োমনোবাক্যে দোা‘আ করছি, আপনি আমাদের উস্তদাজীক কবুল করুন, তাঁকে জান্নাতের সুউঁচ্চ মকাম দান করুন। আমাকে যেভাবে ভালোবেসেছেন আল্লাহও তাঁকে সেভাবে ভালোবাসুন।
অনেক রাতে উস্তাদজী থেকে বিদায় নিয়ে বের হলাম। মন পড়ে থাকলো তাঁর সান্নিধ্যের আশায়। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজে ব্যস্ত থাকায় অনেকদিন আমার শাইখের সাথে সাক্ষাত সম্ভব হয়নি। ইতোমধ্যে সেই দুঃখজনক খবর শুনতে হলো, জানতে পারলাম আমাদের প্রিয় মানুষটিকে আল্লাহ তাঁর সান্নিধ্যে ডেকে নিয়েছেন।
তিনি আমাদের হৃদয়ে ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন। আল্লাহ তা‘আলার কাছে আবারও তাঁর জন্য জান্নাতের দো‘আ করছি। তাঁর পরিবার-পরিজন, সন্তান-সন্তুতি, আত্মীয়-স্বজন সকলকে আল্লাহ দীনের জন্য কবুল করুন। আমাদেরকেও কবুল করুন। আমীন। সুম্মা আমীন।
লেখকঃ
প্রফেসর ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া,
আল-ফিকহ অ্যান্ড লিগ্যাল স্টাডিজ বিভাগ
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।