ড. নকীব মোহাম্মদ নসরুল্লাহ
মাদ্রাসা শিক্ষা জীবনে দ্বীনি ও ইল্মে প্রখর বুৎপত্তি সম্পন্ন অনেক শিক্ষকের সান্নিধ্য লাভ ও তাঁদের কাছে শিক্ষা গ্রহণের সৌভাগ্য আমার হয়েছিল, যাদের অধিকাংশ ইতোমধ্যে এ পৃথিবী ছেড়ে আখেরাতের পথে পাড়ি জমিয়েছেন। শিক্ষক হিসেবে তাঁদের জ্ঞান ও যোগ্যতা মূল্যায়নে আমি স্বভাবতঃ কাউকে প্রাধান্য দিব না, বা তুলনা করে কাউকে ছোট করব না। কারণ তাঁরা প্রত্যেকেই ইসলামী তথা কোরআন, হাদিস ও ফিকহের জ্ঞানের রাজ্যে ছিলেন প্রাতিস্বীকতাপূর্ণ এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, নিজস্ব অঙ্গনে সমহিমায় ভাস্বর অতুলনীয় ব্যক্তিত্ব। তবে আমাকে যদি সার্বিক মূল্যায়নের প্রশ্ন করা হয়, যদি বলা হয় কাকে আমি শ্রেষ্ঠত্বের অভিধায় অভিসিক্ত করতে চাই, তাহলে নিদ্বিধায় আমি বলব, আমার সর্বাধিক প্রিয় উস্তাদ আল্লামা ফখরুদ্দীনকে। তিনি ছিলেন হাদিস শাস্ত্রে এক উচ্চ মর্গীয় বিদ্বগ্ধ পন্ডিত। ইসলামী জ্ঞানের সব অঙ্গনে ছিল তাঁর স্বদর্প বিচরণ। তাঁর মত ইসলামী জ্ঞানের আলোকে উজ্জ্বল ও দীপ্তমান একজন মহান শিক্ষকের কাছে কামিল শ্রেণিতে ইলমে হাদিসের শিক্ষা গ্রহণ আমার জীবনের চরম ও পরম পাওয়া। ছাত্র হিসেবে তাঁর কাছ থেকে অফুরন্ত স্নেহ ও ভালবাসা পেয়েছি। ঢাকা আলীয়া মাদ্রাসায় তাঁর চাকুরী জীবনে যে কয়জন ছাত্র তার ইল্মি জগতের ঘনিষ্ঠ দ্বারে উপনীত হয়েছে, তাদের মধ্যে আমার অবস্থান একেবারে নিচে নয়, আমাকে নিয়ে তিনি দ্বীনি ইলমের খেদমতের অনেক বড় স্বপ্ন দেখতেন, কেন দেখতেন তাঁর যথার্থ উত্তর আজও আমার কাছে নেই।
আমার এই প্রিয় শিক্ষকের জীবনের উপর যত বারই কিছু লিখার প্রয়াস চালিয়েছি বেশিদূর কলম যেতে পারিনি, বার বার স্মৃতি আমাকে তাড়িত করে ফিরেছে, অশ্রুসিক্ত হয়েছি, স্মৃতিপটে ভেসে উঠেছে আলীয়া মাদ্রাসার শ্রেণিকক্ষ, হুজুরের দরস, চলন-বলন ও হাঁটার স্টাইল, কথা-বার্তার আভিজাত্য, যুক্তির বলিষ্ঠ উপস্থাপন, আরো কত কিছু।
আল্লামা ফখরুদ্দীন হুজুরের অনেক ছাত্রের মত আমিও বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, তাই চিন্তা করলাম, একজন মহান ও আদর্শ শিক্ষকের যে গুণাবলী আমি তাঁর মধ্যে অবলোকন করেছি, যা এখনও আমার শিক্ষক জীবনের অনুপ্রেরণা, সে বিষয়ে সামান্য কিছু আলোকপাত করব। কারণ বিস্তারিত লিখতে গেলে, নিঃসন্দেহে বিশাল গ্রন্থে পরিণত হবে। আমার নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে তিনি ছিলেন একজন পূর্ণমাত্রিক শিক্ষক, জ্ঞানের সাধন ও পাঠ দানের ক্ষেত্রে এক আদর্শ ও মহান শিক্ষকের উজ্জ্বল প্রতিকৃতি। এ বিষয়ে ধারাবাহিকভাবে আমি কয়েকটি উদাহরণ পেশ করব।
একজন আদর্শ শিক্ষকের অন্যতম গুণ হলো তাঁর প্রধান Stakeholder তথা ছাত্রদের কাছে আলোচ্য বিষয় বস্তুকে সহজ ও সাবলীলভাবে উপস্থাপন করা ও বিষয়ের গভীরে প্রবেশ করা। এ গুণটির চমৎকার প্রতিফলন দেখেছি আল্লামা ফখরুদ্দীনের দরসে। তিনি আমাদের শ্রেণি শিক্ষক হিসেবে হাদিসের গ্রন্থ মুসলিম শরীফ পড়িয়েছেন। আল্লামা উবাইদুল হক জালালাবাদীর অবসর গ্রহণের পর কিছুদিন বোখারীও পড়িয়েছেন। ‘মুকাদ্দিমা’-এ মুসলিম বাংলাদেশের মাদ্রাসা ছাত্র ও শিক্ষকদের কাছে কঠিন বাক্য সম্বলিত অনেকটা দূর্বোধ্য আলোচ্য বিষয়। আমারও প্রাক-ধারণা তাই ছিল। আলোচ্য বিষয় হিসেবে যতটা না কঠিন, তার চেয়ে অধিক কঠিন তার প্রকাশভঙ্গি। এ বিষয়টি তিনি আমাদেরকে অত্যন্ত সহজ ও প্রাঞ্জলভাবে পড়িয়েছেন, যা তুলনাহীন। বাক্য চমৎকারভাবে ভেঙে ভেঙে অর্থ বের করে আনার অসাধারণ পারদর্শিতা ছিল তাঁর। কোন বিষয়ে গোঁজা-মিলের আশ্রয় নিতেন না। হাদিস পাঠদানের ক্ষেত্রে প্রশ্ন করলে এত রেফারেন্স সমৃদ্ধ উত্তর দিতেন, শুধু অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতাম, মনে মনে সুবহানাল্লাহ পড়তাম। শ্রেণিকক্ষে তিনি ছিলেন একজন সরলমনা অনুপম মাধুর্যপূর্ণ ছাত্র বান্ধব আলোচক। কোন বিষয়ের প্রশ্নে তিনি ভাসা ভাসা উত্তর দিতেন না, প্রয়োজন হলে সময় নিয়ে পরের ক্লাশে বিস্তারিত আলোচনা করতেন।
হাদিসের দরসে বিভিন্নমুখী বিশ্লেষণ, বিশেষ করে ফিকহী মাসয়ালার অনুপুংখ বিশ্লেষণ, আমাদেরকে নিয়ে যেতো জ্ঞানের অতল্যান্ত সাগরে। হাদিসের সনদের বর্ণনায় তিনি ছিলেন অসম্ভব রকম পারদর্শী। ‘বাহরুল উলুম’ শব্দটি মাদ্রাসা শিক্ষা-জীবনের শুরু থেকে শুনে এসেছি আলীয়া মাদ্রাসায় এসে আল্লামা ফখরুদ্দীনের ক্লাস করার পর ‘বাহারুল উলুমের’ প্রকৃত অর্থ খুঁজে পেয়েছি। আমি পৃথিবীর তিনটি সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি। অস্ট্রেলিয়ার মাকুয়ারী বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডিসহ education-এ একটি diploma ও করেছি। Ideal Teaching এর essential features এর উপরও অনেকগুলো workshop ও করেছি। সে বিবেচনায় আমি আজকে শুকরিয়াস্বরূপ বলছি, আমার উস্তাদ ফখরুদ্দীন হয়তো পৃথিবীর আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ে Teaching Methodology এর শিক্ষা গ্রহণ করেননি। কিন্তু স্বভাবগতভাবে এ বিষয়ে তার innovative চিন্তা-চেতনা ছিল অত্যন্ত সমৃদ্ধ। যার কারণে আর দশজন থেকে তিনি ছিলেন অনেকটা স্বতন্ত্র ও ব্যতিক্রমী। তাঁর পাঠদানের চমৎকার কৌশল ও জ্ঞানের গভীরতায় মুগ্ধ হয়ে প্রথম দিন থেকেই তাঁর মত শিক্ষকের ছাত্র হওয়াকে অত্যন্ত গৌরব, অহংকার ও সৌভাগ্যের বিষয় মনে হত। মনে হতো, মাদ্রাসা শিক্ষা জীবনের সমাপনী বর্ষে তিনি আমাদের জন্য রহমতস্বরূপ। আমার মত প্রত্যেকটি ছাত্রেরই এই ধারণা ছিল। প্রত্যেকদিনই অপেক্ষা করতাম পরের দিনের দরসের জন্য।
একজন আদর্শ শিক্ষকের আর একটি গুণ হলো পূর্ণমাত্রিক ক্লাস প্রস্তুতি। ক্লাসে যাওয়ার পূর্বে প্রস্তাবিত বিষয়ে গভীর ও ব্যাপক অধ্যয়ন থাকলে ছাত্রদের প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর প্রদান করা যায়, বিষয়ীর উপস্থাপনাও সহজ হয়। শিক্ষা দানের ক্ষেত্রে এটা বিশ্বব্যাপী একটি স্বীকৃত বিষয়। আমার গোটা শিক্ষক ও শিক্ষা জীবনের অভিজ্ঞতায় তাঁর মত ক্লাস প্রস্তুত শিক্ষক আমার চোখে পড়েনি। শিক্ষাদান কালে মনে হতো সব জিনিস তাঁর চোখের সামনে ভাসছে, অন্তর চোখে উদ্ধৃত্ত গ্রন্থের পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা দেখছেন। আমি অনেকদিন ক্লাস শুরু হওয়ার আগে তাঁর রুমে গিয়ে দেখেছি তিনি অধ্যয়নে ব্যস্ত। তিনি আমাকে বলতেন, ঘুম, অজু-গোসল ও খাওয়া ছাড়া আমি সবসময় পড়ি। প্রস্তুতির আর একটি নমুনা ছিল, উনি সবকিছু ডায়েরীতে নোট রাখতেন। উনার ডায়েরী মাঝে মাঝে পড়ার সুযোগ হয়েছে। তিনি সব কিছুর স্বল্প বিস্তারে চমৎকার নোট রাখতেন। মুসলিম শরীফে ‘কিতাবুল বুয়ু’ উপর পাঠদান কালে এত ব্যাপক ও বিশ্লেষণধর্মী আলোচনা করেছেন যা আজও আমার স্মৃতি ধারণ করে আছে। কোন শরয়ী মাসয়ালা বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে তাঁর মধ্যে ইজতিহাদের পূর্ণমাত্রিক যোগ্যতা আমরা দেখতে পেতাম। আমি মাঝে মাঝে শ্রেণিকক্ষে নিজের ব্যক্তিগত অভিমত পেশ করতাম, বিভিন্ন প্রশ্ন উত্থাপন করতাম, কোন বিষয়ে দ্বিমতের ভাব প্রকাশ করতাম, উনি সহজভাবে সেটাকে গ্রহণ করতেন। এসব কারণে রসিকতার ছলে মাঝে মাঝে আমাকে ফিকহী ইমামদের নামে ডাকতেন। আমার দৃষ্টিতে তিনি ছিলেন প্রকৃতপক্ষে একজন গবেষণাধর্মী শিক্ষক যা মাদ্রাসা শিক্ষকদের ক্ষেত্রে অনেকাংশে অনুপস্থিত। কোন বিষয়ে রেফারেন্স ছাড়া কথা বলতেন না, কোন বিষয়ের ব্যাখ্যা ও যুক্তি উপস্থানকালে গবেষণার পদ্ধতিগত নিয়মের ব্যবহার করতেন। ফিকহী মাসয়ালা বর্ণনায় সংশ্লিষ্ট কোরআন ও হাদিসের বক্তব্যকে উছুলে ফিকহের মানদন্ডে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করতেন। আলিম/ফাজিল শ্রেণিতে নুরুল আনওয়ার, মানতিক, আকায়িদ পড়েছি, তবে যথার্থভাবে প্রায়োগিক জ্ঞান লাভ করেছি আল্লামা ফখরুদ্দীনের দরসের মাধ্যমে।
একজন ভাল শিক্ষক শুধু পড়ায় না, বরং পড়তে শিখায়, কিভাবে পড়াতে হবে তা শিখায়। কিভাবে পড়তে হয়, কিভাবে পড়ানোর প্রস্তুতি নিতে হয় এক্ষেত্রে আজও তিনি আমার অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব। তিনি আমাকে স্নেহবশে ‘নসরত’ বলে ডাকতেন। চট্টগ্রামের ভাষায় বলতেন, নসরত কোন জিনিস ‘রেডিমেট’ পড়বেনা, তার অর্থ ক্ষণিকের জন্য বা ভাসা ভাসা পড়বে না, বার বার পড়বে, এমনভাবে পড়বে যাতে স্মৃতিতে স্থায়ীভাবে সংরক্ষিত থাকে। এ মর্মে বিখ্যাত প্রাবন্ধিক আবু সায়িদ আইয়ূবের একটি উক্তি প্রণিধানযোগ্য। তার উক্তি ছিল ‘ষোলটি বই না পড়ে, তার পরিবর্তে চারটি বই, চারবার করে ষোলবার পড়া উত্তম’। আল্লামা ফখরুদ্দীন আমাকে বলেছেন, যখন তুমি কোন বিষয়ে গভীর অধ্যয়নের পরিকল্পনা করবে, তখন সংশ্লিষ্ট সকল গ্রন্থাদি ও গবেষণাধর্মী লেখনীসমূহ যোগাড় করবে এবং সবকিছু অদ্যোপান্ত পড়বে এবং প্রয়োজনীয় নোট রাখবে। মনে রাখতে হলে, বারবার পড়বে ও ভালভাবে বুঝবে। কোন বিষয়ে পরিষ্কারভাবে না বুঝে সামনে অগ্রসর হতে নিষেধ করতেন। এজন্যে তাঁর সাথে ক্লাসের বাইরে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনায় মনে হতো সবকিছু তাঁর সামনে আয়নার মত স্বচ্ছ।
মাদ্রাসার ফাজিল-কামিল শ্রেণির সিলেবাসভুক্ত মা’কুলাতের কিতাবসমূহ তুলনামূলক ধ্রুপদী ভাষা সম্বলিত। শুধু আরবী ভাষা জ্ঞান থাকলে এ কিতাবসমূহ সঠিকভাবে বুঝা যায় না। কিভাবে একটি কঠিন বাক্যকে বিশ্লেষণের স্বার্থে ভাঙ্গতে হয়, বিভিন্নমুখী ব্যাখ্যা করতে হয় সে বিষয়ে তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। এ কারণে আলীয়া মাদ্রাসায় পড়াকালীন সময়ে আমি ঢাকার কয়েকটি কওমী মাদ্রাসার দাওরাহ হাদিসের সবকে বসেছি, অধিকাংশ আলোচনা আমার কাছে অনেকটা অগভীর ও দায়সারা গোছের মনের হয়েছে। অবশ্য উস্তাদরা অনেক মুহাক্কিক ছিলেন, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। মূল সত্য হলো, উস্তাদ ফখরুদ্দীনের কাছে কোন বিষয়ে সবক গ্রহণের পর সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অন্য কারো কাছে সমভাবে তৃপ্ত হওয়া অত্যন্ত কঠিন ছিল।
একজন ভাল ও আদর্শ শিক্ষকের আরও একটি গুণ হলো interdisciplinary knowledge ও সমসাময়িক বিষয়ে সম্যক ধারণা থাকা। মাদ্রাসায় কোরআন ও হাদিসে বুৎপত্তি অর্জন করতে হলে অবশ্য অন্যান্য প্রয়োজনীয় বিষয় তথা ফিক্হ, উসুল ফিক্হ, বালাগাত ও মানতিকে স্বল্প বিস্তর ধারণা থাকা আবশ্যক। আল্লামা ফখরুদ্দীনের উপরিক্ত বিষয়সমূহে গভীর পাণ্ডিত্য ছিল। ইসলামের জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় তার বিচরণ ছিল ঈর্ষনীয়। পাশাপাশি আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের ও প্রয়োজনীয় ধারণাও রাখতেন। যার কারণে তুলনামূলক আলোচনা করতে সক্ষম ছিলেন। নিজে রাজনীতি করতেন না, তবে সম-সাময়িক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি সম্পর্কে বেশ ভাল ধারণা রাখতেন। নিয়মিত একটি দৈনিক পত্রিকা খুব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তেন।
তিনি ছিলেন একজন সত্যবাদী, তাওহীদপন্থী শিক্ষক। প্রত্যেকটি বিষয়কে যুক্তিগ্রাহ্য করে তুলতে সচেষ্ট ছিলেন। বাতিল ও ভুয়া পীর ও তথাকথিত সুফীবাদের ঘোর বিরোধী ছিলেন। যা তার দরসের মাধ্যমে প্রকাশ পেত। তবে হাদিস নির্ভর সুন্নত পন্থী ছিলেন।
ছাত্র-শিক্ষকের সুসম্পর্ক আবহমানকাল ধরে উন্নত শিক্ষা অর্জনের একটি স্বীকৃত মাধ্যম। আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থায়ও ছাত্র-শিক্ষকের সুসম্পর্ককে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়া হয়। ছাত্র-শিক্ষক সুসম্পর্কের ক্ষেত্রে আল্লামা ফখরুদ্দীন ছিলেন এক নজীরবিহীন ব্যক্তিত্ব। ছাত্রদের জন্য তিনি ছিলেন অত্যন্ত সহজগম্য, যেকোন বিষয়ে ছাত্ররা তাঁর সাথে মত বিনিময় করতে পারত। ছাত্রের কল্যাণই তাঁর কাছে ছিল মূখ্য বিষয়। ভাল ছাত্রদের প্রতি তাঁর আন্তরিকতা হয়তো সবারমত একটু বেশি ছিল। আমার মনে পড়ে আমাদের সময়ে কামিল শ্রেনীর প্রশ্নপত্রের ধরনে অনেকটা পরিবর্তন ঘটে। রচনামূলক প্রশ্নের পরিবর্তে হাদিস ও তাফসীর বিষয়ে অধিক সংখ্যক ছোট প্রশ্নের সংযোজনের পূর্ব বিজ্ঞপ্তি আমাদের দেয়া হয়। আমাদের কাছে তখন কোন মডেল প্রশ্ন ছিলনা এবং কি ধরনের প্রশ্ন হতে পারে সে বিষয়ে অতটা ধারণাও ছিলনা। ফখরুদ্দীন হুজুর আমাদের রাত্রে ক্লাস নেয়ার ব্যবস্থা করলেন এবং কি ধরনের প্রশ্ন হতে পারে এজন্য গুরুত্বপূর্ণ হাদিস ধরে ধরে প্রশ্ন তৈরী করতেন। সম্পর্কের দিক দিয়ে অনেকটা কাছের ছিলাম বলে হুজুর অনেকদিন নিজে ডেকে নিয়ে আমাকে পড়িয়েছেন।
ব্যক্তিগতভাবে তিনি খুবই মজার লোক ছিলেন। গল্প করতে খুবই পছন্দ করতেন। অধিকাংশ গল্পের পিছনে প্রায়শঃ শিক্ষণীয় বিষয় থাকত। আমরাও গল্প করতাম, আমাদের গল্প শুনে মাঝে মাঝে হৃদয়জোড়া অট্ট হাসি দিতেন। তিনি ভোজন রসিকও ছিলেন বটে। পুরানো ঢাকার লালবাগের মোড়ের তেহারী, চকবাজারের খাওয়া-দাওয়ার বিরিয়ানী তাঁর খুব প্রিয় ছিল। আমি তার সাথে অনেকবার এসকল হোটেলে খেয়েছি। প্রায়ই হেটে হেটে গল্প করতে করতে যেতাম। তখনতো এরকম রিকসার ও গাড়ি ভিড় ছিলনা। মাঝে মাঝে আমাকে বলতেন, “আমার বিশ্বাস তুমি মাদ্রাসা শিক্ষায় থাকলে অনেক বড় মুহাদিছ হবে, আমি তোমাকে সেভাবেই প্রস্তুত করতে চাই”। ছাত্রদেরকে আর্থিকভাবেও সাহায্য করতেন যেটা আমার ক্ষেত্রেও ঘটেছিল। আমার হয়তো ওভাবে দরকার হতো না। আমি কোন কিতাব কিনব বলে সিদ্ধান্ত নিলে উনি বলতেন, টাকার দরকার হলে আমার কাছ থেকে নিও।
ছাত্রদেরকে সবসময়ই জ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে উৎসাহ প্রদান করতেন। পরিচিতদের কাছে নিজের ছাত্রদের ভূয়সী প্রশংসা করতেন। পূর্ববর্তী ছাত্রদের প্রশংসা করতেন পরবর্তীদের কাছে। আমার এখনও মনে পড়ে, একবার রিয়াদের মহম্মদ বিন সউদ ইউনিভার্সিটির রেক্টরের সম্মানে ঢাকা আলীয়া মাদ্রাসার মিলনায়তনে এক সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানে আমি ছাত্রদের পক্ষ থেকে আরবীতে বক্তৃতা দিয়েছিলাম। হুজুর তখন সামনের সারিতে বসা ছিলেন। বক্তৃতার পর মহামান্য অতিথি আমাকে ‘খতীবে আজীম’ বলেছিলেন। ফখরুদ্দীন হুজুর আমার এই বক্তৃতার প্রশংসা কতজনের কাছে করেছেন তার অন্ত নেই। এভাবে তিনি সবার ক্ষেত্রে যার যার বিশেষ গুণের প্রশংসা করতেন। আমাদের সালাহউদ্দিন আইয়ূব যে এখন মিচিগান স্টেট ইউনিভার্সিটির শিক্ষক, তার অসম্ভব লিখনী শক্তির প্রশংসা হুজুর আমিসহ অনেকের কাছে করেছেন।
একজন সফল শিক্ষকের পাশাপাশি তিনি ব্যক্তিগত জীবনে ছিলেন সৎ, দায়িত্বনিষ্ঠ ও সিদ্ধান্তে দৃঢ়চেতা, আদর্শবাদী ও সাহসী ব্যক্তিত্ব।
ছাত্র হিসেবে তার প্রতি আমার দায় আমি কখনও শোধ করতে পারব না। আমার শিক্ষা জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষক তিনি, তিনি এখনও আমার অনুকরণীয় আদর্শ। আমি প্রতিনিয়ত আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করি আল্লাহ যেন তাঁকে জান্নাতের উচ্চ মর্যাদা দান করেন। আমীন।
লেখক : অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়