ইসরায়েলে নতুন করে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে ইরান কাছের মানুষকে আলিঙ্গন করা কেন জরুরি? একদিনে আরও ২৬ জনের করোনা শনাক্ত, মৃত্যু ১ পাল্টা হামলার মুখে যাত্রী ছাড়াই বিদেশে বিমান সরিয়ে নিচ্ছে ইসরায়েল জাতীয় নির্বাচনের তারিখ নিয়ে সমাঝোতা একটি ইতিবাচক দিক : আতিকুর রহমান জামায়াতের ১নং ওয়ার্ড কর্তৃক সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত নাগেশ্বরীতে বাণিজ্যমেলা বন্ধের দাবিতে মানববন্ধন রায়গঞ্জে মাছ ধরতে গিয়ে পানিতে ডুবে ভাই বোনের মর্মান্তিক মৃত্যু সাতক্ষীরা কালিগঞ্জে আওয়ামী লীগ নেতা মোজাহার হোসেন কান্টু গ্রেপ্তার শ্রীপুরে দফায় দফায় হামলা ও ভাঙচুর, অর্ধশতাধিক বাড়িঘর ও দোকানপাটে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ লালপুরে জামায়াতের ঈদ পুনর্মিলনী অনুষ্ঠিত লালপুরে বিএনপির ঈদ পুনর্মিলনীতে জনতার ঢল! ঈশ্বরগঞ্জে সড়ক দুর্ঘটনায় ১ জন নিহত সাবেক সংরক্ষিত এমপি’র বাড়িতে যৌথবাহিনীর অভিযান: ইয়াবা-অস্ত্রসহ পুত্র আটক সুন্দরগঞ্জে জামায়াত কর্মী হত্যা মামলায় যুবলীগ নেতা আজম কারাগারে কালাইয়ে দুধর্ষ ডাকাতির ঘটনায় চিকন আলী নামে এক আন্তজেলা ডাকাত দলের সদস্য গ্রেপ্তার পাঁচ ব্যাংক মিলে হচ্ছে এক ব্যাংক, চাকরি হারাবেন না কর্মীরা নেতানিয়াহুর জন্য বিশ্ব আরও বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে’ গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হককে অবরুদ্ধের প্রতিবাদে পীরগাছায় মশাল মিছিল সড়ক দুর্ঘটনায় লালপুরের যুবকের মৃত্যু

অম্লান স্মৃতির সজীব ছায়ায় প্রিন্সিপাল আল্লামা ফখরুদ্দিন (রহ.)

অম্লান স্মৃতির সজীব ছায়ায় প্রিন্সিপাল আল্লামা ফখরুদ্দিন (রহ.)

  অধ্যক্ষ মোঃ এহছানুল হক এহছান


শতাব্দীর প্রাচীনতম ঐতিহ্যবাহী দ্বীনি বিদ্যাপীঠ সিলেট সরকারী আলিয়া মাদরাসায় অধ্যয়নকালীন যে সকল আছাতাযায়ে কেরামের নেক সোহবত লাভে আমাদের জীবন ধন্য হয়েছিল, আমরা নিজেদেরকে পরমসৌভাগ্যবান মনে করেছিলাম। যারা নিঃস্বার্থভাবে নিরলস শ্রম দিয়েছেন আমাদের তরে। যারা নির্ধারিত ক্লাসের পরও সকাল-সন্ধ্যা উদারচিত্তে আমাদের ক্লাস নিয়েছেন, অক্লান্ত পরিশ্রম করে নির্বাচিত সিলেবাস শেষ করেছেন। যাদের  স্নেহ ভালবাসা আমাদের চলার পথকে গতিশীল করেছে। যাদের সদুপদেশ আমাদেরকে দেখিয়েছে সত্য, সুন্দর ও কল্যাণের পথ। তাঁদের অন্যতম প্রধান দেশ বরেন্য আলেমে দ্বীন, প্রথিতযশা শায়খুল হাদীস আমাদের পরম শ্রদ্ধাভাজন প্রানপ্রিয় প্রিন্সিপাল জনাব আল্লামা ফখরুদ্দিন (রহ.)। কার্লাইল লিখেছিলেন মানব সভ্যতার ইতিহাস প্রকৃতপক্ষে শ্রেষ্ঠ মানুষদের ইতিহাস। এই ইতিহাস জানতে হলে ধুলো কাদা মুছে শ্রেষ্ঠ মানুষদের যথাস্থানে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। কার্লাইলের এই ‘হিরো ওমরশিপ’ সমালোচিত হয়েছে পরবর্তীকালে। শুধু তাই নয়, সম্পূর্ণ উল্টো পথের কথাও বলেছেন চিন্তানায়করা। আর তাদের চিন্তার সূত্রে ইদানিং ব্যক্তিপুজা নিন্দিত হয়েছে বার বার। তবুও ব্যক্তির আলাদা একটা আকর্ষণ থেকেই যায়। এই আকর্ষণ বোধহয় ব্যক্তিপুজা বিরোধী তাত্ত্বিকরাও এড়াতে পারেন না সব সময়। একজন খ্যাত রাষ্ট্রনেতা, বিশিষ্ট বিজ্ঞানী, দার্শনিক, লেখক, গবেষক ও শিক্ষক তাদের কাজ ও ব্যক্তিত্বের যাদুতে আচ্ছন্ন করেন অনেককেই। এই আচ্ছন্নতার আর এক নাম শ্রদ্ধাবোধ। এ-কে অস্বীকার করা যায় না। আমাদের পরম শ্রদ্ধেয় প্রিন্সিপাল জনাব এরকমই এক ব্যক্তিত্ব। তাইতো আজ বারবার মনে পড়ে জনাবের কথা। তার ব্যক্তিত্ব, দক্ষতা ও বিচক্ষণতা স্মরণ করে আমাদের মাথা শ্রদ্ধায় নত হয়ে আসে। তিনি ছিলেন আমাদের প্রেরণার উৎস, গতি সঞ্চারক ও জীবন যুদ্ধে জয়ী হবার সফল দিক নির্দেশক। শিক্ষার্থী আর শিক্ষক পরস্পরের সম্পূরক। শিক্ষার্থীর জ্ঞান প্রদীপ জেলে দিতে শিক্ষকের ভূমিকা প্রশ্নাতিত। তাই শিক্ষার্থীর কাছে শিক্ষকের ঋণ আমরণ। কোন কিছুতে এ ঋন শোধ হবার নয়। সিলেট সরকারী আলিয়া মাদরাসায় পাঠকালীন সময়ে প্রিন্সিপাল জনাবের যে সজীব সন্নিধ্য পেয়েছি; সে আলোকেই হলফ করে বলতে দ্বিধা নেই তিনি ছিলেন বহু গুণে গুণান্বিত এবং বহু বিশেষণে বিশেষিত একজন কৃতি শিক্ষক। এই ক্ষুদ্র নিবন্ধের প্রয়াসে আজ আফসোসে কলিজা বিদীর্ণ হচ্ছে। মাদরাসায় জনাবের নেক জবান থেকে কত উপদেশ বাণী শুনতে পেতাম, জানতে পেতাম। তাঁর নুরানী চেহারা মোবারক দেখে তৃপ্ত হতাম। বিনীত আরজি জানিয়ে প্রানভরে দু'আ নিয়ে আসতাম। যা হত আগামী দিনের সম্বল ইত্যাদি কত কথা আজ মনের গভীরে উদয় হচ্ছে। হায়রে! কে জানতো তিনি একদিন আমাদের ছেড়ে পরপারে মালিক ও মাওলার পরম সান্নিধ্যে চলে যাবেন। আজ শোকার্ত হৃদয়ে কি লিখব আমি? ভাব-ভাষা, গতি-ছন্দ সব হারিয়ে ফেলেছি। তাছাড়া জনাবের বিশাল ব্যক্তিত্ব ও গুণাবলী, ব্যক্ত করার শক্তি, সাহস এবং যোগ্যতা আমার ভাষা ও কলমের বাইরে। শুধু বিচ্ছেদ-বেদনার বিশাল বিশাল ঢেউ এসে আছরে পড়ছে হৃদয়ের বেলাভূমে। সব কিছু তালগোল পেকে যাচ্ছে এইক্ষণ। জনাবের কর্ম ও সাধনার বিশালত্বের পরিমাপ করা কী আমার সাধ্যে? মানসিক অস্থিরতায় কি লিখা যায়? তবুও লিখছি, লিখার প্রয়াস চালাচ্ছি। লিখছি হৃদয়ের টানে; ব্যাকুল আকুল চিত্তে। তাই আবেগ জড়িত লেখাটির মধ্যে ত্রুটি থেকে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়। সময়ের বিশালতায় খুবই সামান্য সময় তার পতঃপবিত্র সান্নিধ্য আমার ভাগ্যে নসীব হয়েছিল। আর কত অসংখ্য স্মৃতি জড়িয়ে আছে আমার প্রতিটি সত্ত্বায় আর চিরায়ত শ্রদ্ধায়। স্বল্প পরিসরে জনাবের ইলম, প্রজ্ঞা, সততা, সাধুতা, উদারতা, সহৃদয়তা, দূরদর্শিতা, ন্যায়নিষ্ঠতা, বিচক্ষণতা, বদান্যতা ইত্যাদি গুণের কথা ব্যক্ত করা সম্ভব নয় বিধায় সকল গুণের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখে প্রতিনিধিত্ব স্বরূপ তাঁর গঠনমূলক কর্মচিন্তা উন্নয়নমূখী কর্মধারা, প্রোজ্জ্বল প্রতিভা, বিস্ময়কর শিক্ষাদান ও প্রাতিষ্ঠানিক কর্মকাণ্ডের যৎকিঞ্চিত চিত্রায়নের প্রয়াস চালাচ্ছি। তবে এ কোন ঋণ শোধের অভিলাষ নয় এ হচ্ছে একজন ছাত্রের পক্ষ থেকে সান্নিধ্যের আলোকে প্রাণের তাগিদ তাড়িত হৃদয় নিংড়ানো স্মৃতিচারণ। ছাত্র-শিক্ষক তথা সংশ্লিষ্ট সকলের জীবন চলার পথে মূল্যবান পাথেয় এবং সুন্দর ও আদর্শ জীবন গঠনের অনুপম দিকনির্দেশনা হিসেবে অম্লান স্মৃতি থেকে তাঁর শিক্ষকতা ও প্রাতিষ্ঠানিক কর্মকাণ্ড যেভাবে যতটুকু আবিষ্কার করতে পেরেছি তা নিম্নরূপ:

১ (এক). নীতিনিষ্ট শিক্ষক ও শিক্ষাদানে তার অনন্যতা : প্রিন্সিপাল জনাব মাদরাসা পরিচালনার কাজে এবং প্রশাসনিক বিবিধ ব্যাপারে অতিমাত্রায় ব্যস্ত থাকলেও ক্সদনিক অন্ততঃ ২-৩ ঘন্টা শ্রেণি পাঠনায় নিযুক্ত থাকতেন। তিনি যেন মনে করতেন, ছাত্রদের চিত্তে সাধনাশীল কর্মতৎপরতা এবং দায়িত্ববোধ জাগ্রত করতে হলে নিজেকে উত্তম শিক্ষকতায় পারদর্শী হতে হবে। জনাবের চাকুরী জীবন শুরু হয়েছিল শিক্ষকতা দিয়ে এবং চাকুরী জীবন শেষ করেন শিক্ষক হিসেবেই। তাঁর শিক্ষকতা জীবন স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জল। প্রতিভাদীপ্ত সফল শিক্ষক হিসেবে তাঁর কাছ থেকে সর্বক্ষণ সততা ও আন্তরিকতার পরিচয় ফুটে উঠতো। শিক্ষক হিসেবে তাকে কখনও রাগ করতে দেখিনি। অপ্রীতিকর কোন প্রসঙ্গে কথা বলার সময় তিনি একটু  গম্ভীর্যের সঙ্গে কথা বলতেন। বুঝা যেত যে, তিনি অসন্তুষ্ট হয়েছেন। কিন্তু পরক্ষণেই তিনি স্নিগ্ধ স্মিত হাসি (তাবাসসুম) দিয়ে সবার মনোযোগ আকর্ষণ করতেন। তাঁর সহজ, সরল ও সুন্দর কিন্তু গাম্ভীর্যপূর্ণ আচরণ আমাদেরকে খুবই প্রভাব বিস্তার করত। আমাদের শিক্ষকদের মধ্যে তাকে মনে হত অসাধারণ। পরবর্তী জীবনে এ ধারণা আরো দৃঢ় হয়েছে। একজন নীতিনিষ্ট শিক্ষকের যতগুলো গুণ দরকার প্রিন্সিপাল জনাবের ছিল তার চেয়েও বেশী কিছু গুণ। তিনি ছিলেন যথার্থই একজন সফল ও চমৎকার শিক্ষক। প্রখর মেধাসম্পন্ন এই শিক্ষক আমাদেরকে বোখারী শরীফ পড়াতেন। তার পড়ানোকে আদরের মতই মনে হত। বুলন্দ আওয়াজে পড়াতেন এবং থেমে থেমে অত্যন্ত স্পষ্টভাবে উচ্চারণ করে সুন্দর করে বুঝিয়ে দিতেন। তিনি চাইতেন শিক্ষার্থীরা প্রতিটি লাইন ধরে ধরে বুঝে বুঝে পড়বে। অর্থসহ প্রতিটি শব্দের তাহকিক শিখবে। সবাইকে তিনি এভাবে পড়তে উৎসাহ দিতেন। তার পাঠদানের অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল। তিনি ক্লাসে যখন পড়াতেন; নিরব নিস্তব্ধ হয়ে যেতে সব। এমনি সহজ ভাষায় আরবী, বাংলা উর্দু ও ফার্সী মিলিয়ে আলাপী ভঙ্গিতে পড়ালেও আমরা কিন্তু মেরুদণ্ড সোজা রেখে অবাক বিস্ময়ে তন্ময় হয়ে শুনতাম। তিনি দরদ দিয়ে পড়া শিখিয়ে দিতেন। পড়া আদায় করার অপূর্ব কৌশলও তিনি জানতেন। জনাবের ক্লাসে পাঠ নিতে গিয়ে আমরা শিখেছি কেমন করে সহজ ভাষায় আলাপী ভঙ্গিতে পাঠ্য বিষয় তুলে দেয়া যায়। কিভাবে প্রয়োজনে কঠোর হয়ে ক্লাসের সবার মনোযোগ আকর্ষণ করা যায়। নির্দিষ্ট বিষয় ক্লাসে বসেই কেমন করে ছাত্রদের শিখিয়ে দেয়া যায়; এমনি পাঠদান সংশ্লিষ্ট আরো বহু বিষয়। সবাই শিক্ষক নয়; কেউ কেউ শিক্ষক। আমাদের প্রিন্সিপাল জনাব ছিলেন জাত শিক্ষক, যেন শিক্ষক হয়েই জন্মেছিলেন তিনি। শিক্ষক আমাদের আরও ছিলেন আরও আছেন। কিন্তু প্রিন্সিপাল জনাবের মত শিক্ষক আমরা পাইনি, পাবোও না। তার মত শিক্ষক গন্ডায় গন্ডায় জন্ম নেয় না। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন, ‘কেবল তিনিই ঠিক ঠিক আচার্য নামের যোগ্য, যিনি নিজেকে এক মুহুর্তে যেন সহস্র বিভিন্ন ব্যক্তিতে পরিণত করতে পারেন। কেবল তিনিই যথার্থ আচার্য, যিনি সহজেই নিজেকে শিষ্যের অবস্থায় নিয়ে যেতে পারেন, নিজের শক্তি শিষ্যের মধ্যে সঞ্চারিত করে তার চোখ দিয়ে তিনি দেখতে পান, তার কান দিয়ে তিনি শুনতে পান, তার মন দিয়ে তিনি বুঝতে পারেন। এরকম আচার্যই ঠিক ঠিক শিক্ষা দিতে পারেন; অন্য কেউ নয়।' পরম শ্রদ্ধাস্পদেষু প্রিন্সিপাল জনাবের আদর্শ ছিল- ‘সহজ জীবন মহৎ ভাবনা।’ শিক্ষার্থীদের প্রতি তার গভীর অনুরাগ এবং সুকুমার শিক্ষার্থীদের প্রতি অপত্য স্নেহরূপ মমতা তাঁকে শিক্ষা কর্মে যেমন স্বতঃঅনুপ্রাণিত উদ্দীপ্ত এবং কর্মনিষ্ঠ রাখত, তেমনি অধ্যয়নের প্রতি শিক্ষার্থীদের ঔৎসুক্য সঞ্চারে সমুৎসক রাখতে অপরিমেয় প্রেরণা যোগাত। তাঁর ত্যাগ তিতিক্ষা ও প্রাণময়তা শিক্ষার্থীদের জীবন চলার প্রতিটি কাজে অনুপ্রেরণার সঞ্চার করত। তাঁর মত ছাত্রদের প্রতি সহৃদয় শিক্ষক অতি বিরল। সহৃদয়তার বন্ধনে আবদ্ধ করে তিনি ছাত্রদের মনমন্দিরে শ্রদ্ধা ও ভালবাসার পিরামিড রচনা করেছিলেন। তাইতো তার ইন্তিকালের বিরহের রাগিনীতে ছাত্রদের হৃদয়ের গভীরে অনুভূত হচ্ছে নিদারুন শুন্যতা। কী-যে এক অব্যক্ত ভয়ঙ্কর যন্ত্রনায় কেঁদে উঠছে আহত অন্তরগুলো। তিনি ছিলেন ছাত্রদের কাছে কখনও দরদী পিতার মত আপন আবার কখনও হিতাকাঙ্খী বন্ধুর মত স্বজন। আমরা অনেক সময় একান্ত ব্যক্তিগত বিষয় নিয়েও জনাবের সাথে আলাপ করতাম এবং পরামর্শ ও দুআ নিতে পারতাম। ছাত্রদের কাছে পেলেই তিনি উর্দু-ফার্সী শে’র আশআর ও হাদীসের উদ্ধৃতি দিয়ে ভাল লেখাপড়ার এবং আদর্শ জীবন গড়ার তাগিদ দিতেন। ছাত্ররাও সবসময় তাকে অনুসরণ করে চলতো। যখন দূরে চলে যেত তখন যেন তার অদৃশ্য আকর্ষণ অনুভব করত হৃদয়ের গভীরে মন চাইত আবার ছুটে যাক প্রানভরে দেখে আসুক; মনে হয় যেন কত যুগ যুগ ধরে দেখেনি তাকে। কী-যে এক অনাবিল আকর্ষণে আমরা সময়ে অসময়ে ছুটে যেতাম তার বাসায়। এমনকি ছুটির দিনেও। কিন্তু কোনদিন তার মোবারক চেহারায় বিরক্তির ভাব প্রকাশ পায়নি। যে কেহ তাঁর পবিত্র সান্নিধ্যে আসত সে-ই তার মধুর ব্যবহারে এতই মুগ্ধ হত যে, মনে করত আমিই বোধ হয় তার কাছে সবচেয়ে বেশি প্রিয়। আমারও তাই মনে হত। ছাত্রদের প্রতি তার এ মমত্ববোধ এবং তাদের কল্যাণ সাধন যে কত বড় মহৎকর্ম তার মূল্যায়ন করা আমার পক্ষে সাধ্যাতীত বিধায় অনন্যোপায় হয়ে বিশ্বখ্যাত দার্শনিক, কবি ও গণিতিক ওমর কৈয়মের দারস্থ হচ্ছি। তাঁর কথায়-

“ধুসর মরুর ঊষর বুকে বিশাল যদি শহর গড়, 
একটি জীবন সফল করা তার চাইতে অনেক বড়।

একটি উদাস হৃদয় যদি বাধতে পার প্রেমের ডোরে,

বন্দি শতেক মুক্তিদানের চাইতে সে যে শ্রেষ্ঠ ওরে।” 

পরম প্রীতিময় প্রিন্সিপাল জনাব লেখাপড়ার পাশাপাশি ছাত্রদের চলা-ফেরা, উঠা-বাসা, আচার-আচরণ এবং পোশাকপরিচ্ছদ ইত্যাদির প্রতি বিশেষ দৃষ্টি রাখতেন। পোশাক ও চাল-চলনে রাসুলে পাক (স.)-এর পূর্ণ অনুসরণের জন্য বিভিন্নভাবে উদ্বুদ্ধ করতেন। আমার শিক্ষা জীবনে (চরমুহাম্মদপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, সিলেট সরকারী পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়, জালালিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদরাসা, সিলেট সরকারী আলিয়া মাদরাসা, বাদেদেওরাইল ফুলতলী কামিল মাদরাসা, সিলেট এম সি কলেজ ও সিলেট ল'কলেজে) এ ধরনের নিঃস্বার্থ নিরলশ, পরিশ্রমী, ছাত্রদের লেখাপড়ার প্রতি অনুরাগী, রাসুল (স.)-এর আদর্শকে ছাত্রদের মধ্যে পূর্ণ বাস্তবায়নের প্রতি এত উদ্যোগী এবং ছাত্রদের কল্যান কামনায় এরূপ আত্মত্যাগী শিক্ষক খুব কমই দেখেছি। তিনি যেমন ছাত্রদের লেখাপড়া আচার-আচরণ ইত্যাদির উন্নতি ও সংশোধনের প্রতি আগ্রহী ছিলেন তেমনি তাদেরকে নিঃস্বার্থ আদর্শ নায়েবে রাসুল (স.) তৈরীর  আগ্রহ তাকে ব্যাকুল করে তুলত। এই মহান ব্যক্তি ক্লাসে আমাদেরকে নানা ভাবে অনুপ্রাণিত করতেন। আমাদের কামিল ক্লাসের অনেককে নানা উপনামে ডাকতেন। একদিনকার মধুময় স্মৃতি আমার স্মরণপটে বার বার উদ্ভাসিত হচ্ছে, সেই সোনাঝরা দিনটির স্মৃতি মনে করলে আজও হৃদয় পুলকিত হয়। কিন্তু জনসমক্ষে প্রকাশ করা সমীচীন না হলেও বলতে আমার একান্ত ইচ্ছা করছে, জনাব প্রায়ই বাদ এশা কিংবা বাদ ফজর সুলতানে সিলেট হযরত শাহজালাল ইয়ামনী (রহ.)-এর মাজার শরীফ জিয়ারত করতেন। আমি চুপিসারে জনাবের সাথে দু’আয় শরিক হতাম কিন্তু আমার প্রবল ধারণা তিনি আমাকে কখনও দেখেননি। অথচ একদিন ক্লাসে সবার সামনে বলেই দিলেন, এহছান হচ্ছে হযরত শাহজালালের (রহ.) উত্তরসূরী একজন সুফি। সেদিন থেকে তিনি আমাকে ‘সুফি’ বলে ডাকতেন। আমি যখনই সময় ও সুযোগ পেতাম জনাবের মোবারক সান্নিধ্যে যেতাম । কারণ, তার আধ্যাত্মিকতাপূর্ণ প্রতিটি কথা ছিল বিশুদ্ধ, প্রাঞ্জল ও মর্মস্পর্শী। তার প্রতিটি কথা-কাজ এমনকি বাচনভঙ্গি গবেষণায় অমূল্য রত্ন, তত্ত্ব ও তথ্য মিলত। যতবার তাঁর সান্নিধ্যে গিয়েছি ততবারই লক্ষ্য করেছি সারল্যে ভরা উদার হৃদয় ও দিব্য দৃষ্টি। শিক্ষার্থীদের হৃদয়ে তিনি ছিলেন এক পরম স্নেহময় পিতা! তাই তাঁর প্রদীপ্ত চোখের পিতৃত্বময় চাহনি ও মায়াবী মুখাবয়ব ছিল দৃষ্টি নন্দিত। সমুদ্রের মত অপরিমেয় মহিমাপূর্ণ ও অসীম গৌরবযুক্ত ছিলেন তিনি। সুতরাং স্নেহমমতা ভালবাসা আর তাকওয়ার উজ্জলতায় তার চেহারা মোবারক ঘিরে যেন জ্যোৎস্নার প্লাবন বয়ে যেত।  প্রিন্সিপাল জনাব ছিলেন কর্তব্য নিষ্ঠা, পরিচ্ছন্ন চিন্তাধারা এবং উদার মানবিক গুণাবলীর অধিকারী শিক্ষক। তার মত ন্যায়পরায়নতা (integrity) এবং মর্যাদা (Dignity) বোধসম্পন্ন শিক্ষক তাঁর সময়ও বিরল ছিল এবং এখনও বিরল। তাঁকে এ দুটো গুণের বিরল প্রতীক বললেও অত্যুক্তি হবে না। বস্তুত আজকাল তাঁর মত ব্যক্তিত্ববান শিক্ষক চোখেই পড়েনা। স্পষ্টভাষী এবং অনমনীয়ভাবে ঋজু ব্যক্তিত্বের এই শিক্ষক সবার মধ্যে সম্ভ্রম জাগাতেন। আমি তাঁকে কখনও কাউকে 'তুমি' বলে সম্বোধন করতে শুনিনি। তিনি সকলকে 'আপনি' বলে সম্বোধন করতেন। তিনি আভিজাত্য ও সুরুচির মূর্ত প্রতীক ছিলেন। তাঁর অনেক গুণের দ্বারা আমরা প্রভাবিত হয়েছি। যদি আমাকে কেউ জিজ্ঞেস করেন, প্রিন্সিপাল জনাবের কোন গুণটা তোমাকে বেশি আকৃষ্ট করেছে ? তাহলে বলবো এতটুকু যে, নিত্য দিনের সঙ্গী-সাথী ও ছাত্রদের অনাগত ভুল সমুহকে অগ্রিম ক্ষমা করে দেয়ার মত উদার মানসিকতার দৃষ্টান্ত যদি কেউ থেকে থাকেন তাহলে আমাদের প্রিন্সিপাল জনাব ছিলেন এর সেরা দৃষ্টান্ত। শিক্ষকতা একটি মহান পেশা। তবে এ পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তির গুণেই তা মহান। বলতে দিধা নেই, প্রিন্সিপাল জনাবের শিক্ষকতা জীবন নীতিনিষ্টতার মহান আদর্শেই উজ্জিবিত ছিল। শয়নে, স্বপনে ও জাগরণে তথা সর্বাবস্থায় ছাত্রদের কল্যাণে যে সকল মনীষী নিজেদের জীবন উৎসর্গ করে গেছেন তাঁদের মধ্যে আমাদের প্রিন্সিপাল জনাব অন্যতম। সুতরাং সঠিক বিচারে তিনি একজন নীতিনিষ্ট ও আদর্শ শিক্ষক। জ্ঞানের এই আলোকবর্তিকাবাহী মহীয়ানের সোহবত যাদের ঘটেছে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে তারা নিঃসন্দেহে পরম সৌভাগ্যবান। One Light enkindleth enother,Nor gorus less. এক জীবনের এই আদর্শ লক্ষ জীবনে প্রস্ফুটিত হোক এই কামনা। 

২ (দুই). নিপূণ তত্ত্বাবধান ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে তাঁর অনবদ্যতা: মান্যবরেষু প্রিন্সিপাল জনাব নিপূণ তত্ত্বাবধানের ব্যাপারে অন্তরঙ্গতায়, জটিল কাজের সহায়তায়, আদর্শ ও নীতি সংরক্ষণের ক্সনতিক সমর্থন দানে এবং কর্মকুশলতার সক্রিয়তায় সহকর্মী, শিক্ষার্থী এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে অপূর্ব শক্তি ও প্রাণময়তা বজায় রেখে চলতেন। তাঁর তত্ত্বাবধান ছিল ন্যায় কর্মে উদ্বুদ্ধ, অন্যায়ের প্রতি কঠোর-কঠিন, সংস্কারমুক্ত মন ও অনুসন্ধিৎসায় সবল, ঋজু, সাহসী ও শক্তি সঞ্চারী। তিনি প্রতিষ্ঠানের সমুদয় কার্যাবলী পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিচার-বিশ্লেষন করতেন এবং কোন কার্যাবলী প্রতিষ্ঠানকে প্রভাবিত করছে তার খতিয়ান তৈরী  করে কিভাবে দোষমুক্ত করা যেতে পারে সে দিক নির্দেশনাও তাঁকে করতে হত। প্রতিষ্ঠানকে দোষ মুক্ত রাখতে যে সমস্ত সংশোধন প্রয়োজন তার তালিকা প্রস্তুতি থেকে শুরু করে কেন তার সংশোধন প্রয়োজন, কিভাবে তা প্রতিষ্ঠানকে প্রভাবিত করছে, এর ফলে প্রতিষ্ঠান কতটুকু উৎকর্ষতা লাভ করবে ইত্যাদি সকল প্রশ্নের সুচিন্তিত সমাধানও তাঁকে দিতে হত।  পরিবেশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। পরিবেশ বলতে শুধু প্রতিষ্ঠানের ভিতরের ও বাহিরের পরিবেশকেই বুঝায় না; বরং সমগ্র প্রতিষ্ঠানের সার্বিক পরিস্থিতিকেও বুঝায়। প্রিন্সিপাল জনাবের ব্যক্তিত্বের প্রভাব স্বভাবতই মাদরাসার সার্বিক পরিবেশে প্রতিফলিত হত। মাদরাসা ছিল শিক্ষক-শিক্ষার্থী, শিক্ষক-অভিভাবক, শিক্ষক ও সমাজের ক্ষেত্র। তাঁর ব্যক্তিত্বের প্রভাবে সকলের চিত্তেই ‘সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে আমরা পরের তরে’- এ মনোভাব জাগ্রত হত। কারণ একে অন্যের প্রতি সহযোগিতা এবং সহমর্মিতার মনোভাব থাকলে প্রতিষ্ঠানের সঠিক কর্মপন্থায় সুষ্টু সাফল্য অবধারিত- এ সত্য মনে জাগ্রত রেখেই তিনি তাঁর কথায় ও কাজে সংশ্লিষ্ট সকলের প্রীতি, প্রতীতি ও শ্রদ্ধা সহজেই অর্জন করতেন। অপ্রিয় হলেও সত্য যে, কর্মজীবনে নানা বাধা এসে তাঁর প্রশাসনিক কর্মকা-কে বার বার বিঘিœত করলেও তিনি কখনও তা থেকে বিরত হননি। তিনি ছিলেন আত্মসম্মান সম্পর্কে সচেতন একজন প্রশাসক। স্বীয় ব্যক্তিত্ব ও পরিস্তিতি দ্রুত অনুধাবনের বুদ্ধিমত্তা ছিল সকলের কাছে লক্ষণীয়। সুস্থ ও সুশৃংখল পরিবেশে নিরাপদে যাতে শিক্ষার্থীরা লেখাপড়া করতে পারে সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতেন। তিনি ছিলেন আত্মসম্মান সম্পর্কে সচেতন একজন প্রশাসক। স্বীয় ব্যক্তিত্ব ও পরিস্থিতি দ্রুত অনুধাবনের বুদ্ধিমত্তা ছিল সকলের কাছে লক্ষ্যনীয়। সুস্থ ও সুশৃংখল পরিবেশে নিরাপদে যাতে শিক্ষার্থীরা লেখাপড়া করতে পারে সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতেন শিক্ষার্থীদের মাঝে কোন বিরোধ কিংবা বিবাদ সৃষ্টি হতে দেখলে তিনি কখনও নির্বিচার মনোভাব দেখাবার লোক ছিলেন না। সহকর্মী শিক্ষকদের সাথে পরিস্থিতি আলোচনা করেই সর্বাগ্রে স্বেচ্ছায় হস্তক্ষেপ করতেন ঐ সব বিষয়ে। তারপর পরিস্থিতি ঘেটে নিজস্ব প্রভাব বিস্তারক্রমে শিক্ষার্থীদের মাঝে সমস্যা নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করতেন যে কোনভাবেই। মাদরাসার আদর্শ ও ঐতিহ্য সংরক্ষণ এবং উন্নয়ন সাধনের উপযোগী পরিবেশ তৈরীতে তিনি পর্যবেক্ষক, পথনির্দেশক ও সংস্কারের ভূমিকা পালন করতেন। প্রশাসনিক দক্ষতা ও সুপরিচালনার ওপরই প্রতিষ্ঠানের সার্বিক প্রক্রিয়ার সাফল্য নির্ভর করে। প্রিন্সিপাল জনাব মাদরাসার প্রশাসনিক কর্মকান্ডের ব্যাপারে উদ্যম ও উদ্ভাবনশীল এবং কর্মতৎপরতায় অগ্রগণ্য ছিলেন। সাম্প্রতিক গতির যুগে যুগ চেতনায় সঞ্জীবিত ও আধুনিক শিক্ষা বিজ্ঞান ও শিক্ষা মনোবিজ্ঞানের আলোকে পরিশুদ্ধ ছিল তার মন ও মনন। শিক্ষার আত্মিক সার্থকতার প্রতিফলন ঘটে সংস্কৃতিবান মনের পরিচয়ে। প্রিন্সিপাল জনাব তাঁর মার্জিত রুচি, উদার মানবতাবোধ ও সংযত ব্যবহারে সত্যিকারের বিদগ্ধ ব্যক্তিত্বের প্রকাশ নিশ্চিত করতেন। সুশাসনে শৃংখলা রক্ষায়, সংগঠনে, ব্যবস্থাপনায় ও সুনিপূণ কর্মকুশলতায় তিনি বিচক্ষণতার পরিচয় দিতেন। প্রশাসক হিসেবে তিনি ক্ষমতাশীল নির্দেশক না হয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও সংশ্লিষ্টদের কাছে, একজন শুভাকাঙ্খী বন্ধু বিজ্ঞ পরামর্শদাতা এবং কর্তব্যপ্রিয় কর্মী বলে গণ্য ছিলেন। প্রশাসনিক ক্ষেত্রে সৎসাহস, সত্যকামিতা, নিরপেক্ষতা এবং সহৃদয়তা ছিল তাঁর চিত্তের শক্তি ও সৌন্দর্য। যতদূর সম্ভব সংঘর্ষ বা বিবাদ এড়িয়ে মাদরাসার সমস্যাগুলোর মোকাবেলায় তিনি কর্মচাতুর্যের পরিচয় দিতেন। সহকর্মী গভর্ণিংবডির সদস্য, মাদরাসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ব্যবহারে তিনি কখনও তাদের শালীনতা সৌজন্য বা সম্মানের পক্ষে হানিকর কাজ করতেন না। অমায়িকতা ধৈর্য  ও সামঞ্জস্য বজায় রেখে চলবার মত তাৎক্ষণিক ক্সনপুণ্য রক্ষা করে প্রশাসক হিসেবে তাঁর পদের মর্যাদা সংরক্ষণে সদা সচেষ্ট ছিলেন। মাদরাসা পরিচালনা সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয়ে তিনি সর্বদাই সহকর্মীদের সহযোগিতায় দায়িত্ব পালন করতেন। শ্রেণি গঠন, সময় তালিকা ক্সতরি করণ, পাঠ্যপুস্তক নির্বাচন, পাঠ্য তালিকা অনুমোদন, পাঠাগারের পুস্তক নির্বাচন ও ক্রয়, পাঠাগারের পুস্তক সংরক্ষণ ও ব্যবহার, মাদরাসার নিয়ম-শৃংখলার রীতি প্রণয়ন, আসবাবপত্র ও শিক্ষা সরঞ্জাম সংরক্ষণ, বাজেট প্রণয়ন, আর্থিক তহবিল গঠন, ভর্তি ও প্রমোশন নিয়ন্ত্রণ, পরিক্ষা নিয়ন্ত্রণ, বিভিন্ন বিষয়ে ইসলামী শিক্ষা সেমিনার ও সিম্পোজিয়াম ইত্যাদি প্রতিটি কাজই সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে সময়মত সম্পন্ন করে বহুবিদ সমস্যা এড়িয়ে চলতেন। মাদরাসার ভৌত অবকাঠামোর উন্নয়নে তিনি ছিলেন সদা তৎপর। সিলেট সরকারী আলিয়া মাদরাসা ছিল তাঁর প্রাণের চেয়ে প্রিয়। মাদরাসার পরিচর্যায় তিনি ছিলেন অনলস। তিনি সর্বদাই সহৃদয়তার সঙ্গে প্রশাসনিক কাজ করতেন। কর্তৃত্বের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও তিনি তাঁর সমধুর ব্যবহারের গুণে প্রসন্ন পরিম-ল রচনা করেছিলেন। জটিল প্রতিকূলতার মাঝেও সহজতরভাবে প্রশাসনিক কাজ করতে শৈল্পিক  সংবেদনার পরিচয় দিতেন। শান্তশীলতা তাঁর আয়ত্বে থাকত। প্রশাসনিক বিদ্যাবত্তায় কোন রকম মেকি বা ফাঁকির প্রলেপ থাকত না। প্রশাসনিক কাজে যে কোন প্রকার অবগুনের অপবাদে তাঁকে অপদস্থ করেনি। সে বিষয়ে আত্মসমীক্ষণের আলোকে তিনি আত্মবিশ্লেষণ করে ইতিকথা সম্পর্কে সদা সচেতন থাকতেন। কখনও তিনি গুরুভার দায়িত্বের কথা স্মরণ করে পিছিয়ে যাননি। প্রশাসক হিসেবে জনাবের সততা ও দক্ষতার কথা উল্লেখযোগ্য। অর্থকরি খরচ ও হিসাবপত্রের ব্যাপারে তিনি ছিলেন বিশেষভাবে সচেতন, সততা ও দক্ষতার অনন্য উদাহরণ। প্রশাসনিক দায়িত্বে আদর্শ ও নীতির ক্ষেত্রে আপোষহীনতার যে বিরল দৃষ্টান্ত তিনি স্থাপন করেছেন পরবর্তীদের জন্য নিঃসন্দেহে তা অনুকরনীয়।

৩ (তিন). সহকর্মী শিক্ষকদের পেশাগত উন্নতিতে তাঁর অনুপ্রাণনা: প্রিন্সিপাল জনাব ছিলেন প্রখর অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন- যাতে যোগ্য শিক্ষকের যোগ্যতা এবং অযোগ্য শিক্ষকের দুর্বলতা অনায়াসে উপলব্ধি করতে পারতেন। নিজে যেমন আত্মসম্মানবোধে শক্তিমান ছিলেন; তেমনি সহকর্মীদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনে কুণ্ঠাবোধ করতেন না। যোগ্য শিক্ষককে যথার্থ মূল্যায়নের ভিত্তিতে কর্তব্য কাজে আরো সক্রিয় হতে উৎসাহিত করতেন। তিনি এক শিক্ষকের ভাল গুণাবলী অন্য শিক্ষকের মাঝে সংক্রমিত করার চেষ্টা করতেন। শিক্ষা বিষয়ক বিভিন্ন জাতীয় কনফারেন্সে উপস্থিত থাকতেন এবং শিক্ষকদের পেশাগত উন্নতিতে প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করে তা রিপোর্ট আকারে শিক্ষকদের মধ্যে বিতরণ করতেন। শিক্ষকদের পাঠ পরিকল্পনা, পাঠদান প্রণালী, ব্যবহারিক শিক্ষাদানের বাস্তব ক্ষেত্রগুলি পরিদর্শন করে তিনি শিক্ষকদের মৌলিক কর্মাবলী এবং মানবিক গুণের পতি উৎসাহ দিতেন। প্রয়োজনবোধে তাদের যথাযোগ্য স্বীকৃতিও দিতেন। মানুষের জ্ঞানের ভাণ্ডার ক্রমাগত বর্ধিত হচ্ছে। শিক্ষকদেরকে নতুন জ্ঞান আহরণে উদ্বুদ্ধ করা তিনি দায়িত্ব মনে করতেন। কারণ শিক্ষকরা যদি বর্তমান বিজ্ঞানের উন্নতি ও প্রযুক্তির অভিনবতার জগতের ধারণা না রেখে ছাত্রদের পড়াতে চান তাহলে ছাত্ররাও অনেকটা পশ্চাতে পড়ে থাকবে। কাজেই তিনি শিক্ষকদের জন্য বিভিন্ন দৈনিক  ও মাসিক পত্র-পত্রিকা, বিজ্ঞান সাময়িকী ইত্যাদি সরবরাহ করতেন এবং সেমিনার সিম্পোজিয়ামের আয়োজন করতেন। শিক্ষকরা কিভাবে ছাত্রদের মুল্যায়ন করবেন, মূল্যায়ণের জন্য কোন ধরনের পরিক্ষা পদ্ধতি অবলম্বন করা উচিৎ এবং কিভাবে তা পরিচালনা করা যায় ও তাদের প্রকৃত মেধা যাচাই করা যায় সে প্রযুক্তি সম্পর্কে শিক্ষককে অবহিত করতেন। নতুন উদ্ভাবিত শিক্ষা প্রযুক্তি ও উপকরণ কিভাবে ব্যবহার করতে হয় এবং এর প্রয়োগে শিক্ষাদান পদ্ধতিকে আরো উন্নত ও বেগবান করা যায় সে সম্পর্কে তিনি শিক্ষকদের পরামর্শ ও নির্দেশনা দ করতেন। শিক্ষকদের ব্যক্তিগত বিষয়াবলীর খোঁজ-খবর নেয়াও তিনি দায়িত্ব মনে করতেন। কারণ তাদের ব্যক্তিগত বিষয়াবলী পেশাগত বিষয়াবলীকে অবশ্য প্রভাবিত করবে। তবে ছাত্রদের সমক্ষে তিনি কখনও কোন শিক্ষকের প্রতি বিরূপ মন্তব্য করতেন না। প্রয়োজনে তিনি নিজে শিক্ষককে সতন্ত্রভাবে তাঁর কাছে আসার আমন্ত্রন জানাতেন এবং কৌশলে শিক্ষকের ত্রুটি সংশোধনের চেষ্টা করতেন। এক্ষেত্রে তিনি সহানুভূতিশীল সুহৃদের ভূমিকা গ্রহণ করতেন। উল্লেখ্য যে, সকল শিক্ষকের পেশাগত দিকটা একই হলেও ব্যক্তি ও পদবী হিসেবে ভিন্ন এবং তাদের মন-মানসিকতা, আর্থিক ও দৈহিক  সামর্থ্য ভিন্ন হতে বাধ্য। কাজেই তিনি উপরোক্ত দায়িত্ব ও ভূমিকা পালনের সাথে সাথে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের দায়িত্ব ও ভূমিকা পালন করতেন। যেমন: উপাধ্যক্ষের পেশাগত উন্নতিতে, প্রবীন শিক্ষকদের পেশাগত উন্নতিতে, নবীন শিক্ষকদের পেশাগত উন্নতিতে, অলস শিক্ষকদের পেশাগত উন্নতিতে, কর্মবিমুখ শিক্ষকদের পেশাগত উন্নতিতে, একগুয়ে শিক্ষকদের পেশাগত উন্নতিতে তাঁর কর্মকুশলতা অদ্যাপি ছাত্র-শিক্ষক তথা সংশ্লিষ্ট সকলের কাছে এক বিস্ময়ের বস্তু। শিক্ষকের পেশা শিক্ষা দান করা। তাঁর পেশার উন্নতির অর্থই হচ্ছে তার শিক্ষাদান পদ্ধতিকে উন্নত করা। প্রিন্সিপাল জনাব এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব ও ভূমিকা পালন করতেন। তিনি ছিলেন একাধারে শিক্ষকের বন্ধু, দার্শনিক এবং পরিচালক। তিনি বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশের মধ্য দিয়ে শিক্ষকদের ভক্তি শ্রদ্ধা অর্জন করতেন, যার উপর ভিত্তি করে শিক্ষককে সাহায্য সহযোগিতা ও পরামর্শ দান করতেন। শিক্ষক ও তাঁর সচিন্তিত মতামতকে সাদরে গ্রহণ করতেন এবং নিজের পেশাগত উন্নতির লক্ষ্যে পরিচালিত হতেন। প্রিন্সিপাল জনাবের সহকর্মী শিক্ষকরা তাঁর সাথে ভয় ও শ্রদ্ধা মেশানো এক ধরনের সম্পর্ক বজায় রেখে চলতেন। প্রায় সময় অন্যান্য শিক্ষকদের মুখে বলতে শুনেছি- ‘কঠিন আদর্শবাদী তত্ত্বাবধায়কের অধীনে চাকরী করার অসুবিধা কিছু থাকলেও সুযোগ সুবিধা বিস্তর। আদর্শ ও নীতি-নৈতিকতাহীন বসের অধীনে চাকুরী করা সার্থপর-সুযোগ সন্ধানীদের পক্ষে সুখকর হলেও ব্যক্তিত্বশীলদের পক্ষে তা অমর্যাদা ও অবমাননাকর। এ দু’য়ের অভিজ্ঞতা সিলেট সরকারী আলিয়া মাদরাসায় শিক্ষকতা জীবনে হয়েছে। শিক্ষকদের সকলের শীর্ষে উঠতে দেখেছি, একেবারে সকলের পায়ের নিচে পড়তেও দেখেছি। শিক্ষকতার মান কিভাবে বাড়ে তার বহু নজীর প্রিন্সিপাল আল্লামা ফখরুদ্দিন মহোদয় রেখে গেছেন।’ তিনি একদিকে যেমন ছিলেন কর্তব্য পালনে সচেষ্ট, তেমনি অন্যদিকে তাঁর ছিল একটি সহানুভূতিশীল দয়াদ্র হৃদয়। তাঁর উত্তম আদর্শ, সুভাষিতা, অন্তরঙ্গতা, মহানুভবতা এবং চারিত্রিক ক্সবশিষ্ট্যের জন্যই তিনি ছিলেন সকল শিক্ষকের নিকট অত্যন্ত প্রিয় ও সম্মানিত। ক্ষণকাল তাঁর একান্ত সান্নিধ্যের সে․ভাগ্য আমার নসীব হয়েছিল। তাকিয়েছিলাম তার দিকে অনিমেষ দৃষ্টিতে। নতুন শিক্ষার্থী যেমন আগ্রহে নতুন পাঠ বারবার পড়ে মুখস্থ করতে থাকে। আমিও আগ্রহে তাঁকে দেখছিলাম আর পাঠ করছিলাম। পাঠ করে যা মুখস্থ করেছিলাম আজ তাঁর ইন্তিকালের পর স্মৃতি হাতড়াতে গিয়ে তাকে উপজীব্য করে এ ক্ষুদ্র স্মৃতিচারণে ভয়াতুর অতীত আমাকে ভারাক্রান্ত করছে, হৃদয় গহনে ব্যথার জন্ম দিচ্ছে। জনাবের কর্ম জীবনে হয়তো সুখ-সাচ্ছন্দ আসেনি, বৈভব আসেনি; কিন্তু লক্ষ প্রাণের মশাল হয়ে যিনি অগণিত শিক্ষার্থীকে নিষ্কম্প আলোক শিখা হিসেবে আলো বিকিরণ করেছেন- তা তো কোনদিন নির্বাপিত হবার নয়। তাই আজ সুখ-দুঃখের মিশ্র আভায় তাঁর স্মৃতিকথা আমাদের অনুকরনীয় আদর্শ, তাঁর জীবন-কর্ম আমাদের অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত, তাঁর শিক্ষা-দীক্ষা আমাদের উন্নতির চাবিকাটি। হে পালনকর্তা! দেশ বরেণ্য আলেমেদ্বীন, উপমহাদেশের প্রখ্যাত শায়খুল হাদীস, মানুষ গড়ার সুনিপুণ কারিগর, সিলেট সরকারী আলিয়া মাদরাসার সাবেক স্বনামধন্য প্রিন্সিপাল আমাদের প্রাণপ্রিয় উস্তাদ মুহতারামকে জান্নাতের সর্বোচ্চ মাকাম জান্নাতুল ফেরদৌসের মেহমান হিসেবে কবুল করুন এবং আমাদেরকে তাঁর রূহানী দু’আ ও ফয়েজ লাভে ধন্য করুন। আমিন।


লেখক :  প্রিন্সিপাল, রাউৎখাই ইসলামিয়া ক্যাডেট মাদরাসা ওসমানীনগর, সিলেট। 



আরও খবর