১৯৭৩ সালের প্রথম দিকেই রাজশাহী কলেজ থেকে অনার্স পাশ করে এম.এ পড়ার উদ্দেশ্যে ঢাকা আসি, তখন ড. আইউব আলী স্যার আলিয়া মাদরাসার প্রিন্সিপাল ছিলেন। ঢাবি আরবী বিভাগে ভর্তির চেষ্টা করে ব্যর্থ হই, কারণ ঢাবিতে ভর্তির নির্ধারিত সময় অতিবাহিত হওয়ায় তৎকালীন বিভাগীয় প্রধান ড: ইসহাক স্যার আমাকে ভর্তি করবেন না বলে জানিয়ে দেন। আমি ভিসি ও রেজিস্ট্রার মহোদয়ের সংগে সাক্ষাৎ করতে গিয়ে সফল হইনি। পূর্ব পরিচিত হওয়ায় আলিয়ার অধ্যক্ষ আইউব আলী স্যারের সাথে সাক্ষাৎ করে পরামর্শ চাইলাম। স্যার আমাকে আলিয়ায় ভর্তি হতে বললেন কিন্ত আলিয়া হোস্টেলে যেন না থাকি এমন পরামর্শ দেন, কারণ তখন হোস্টেলে সহিংস অবস্থা বিরাজ করছিল। পরে অবশ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সমস্যা মিটে যায়। সেটি ভিন্ন প্রসঙ্গ।
যাই হোক, এমন পরিস্থিতিতে আমি প্রিন্সিপ্যাল স্যারের অনুমতি না নিয়েই আলিয়ার হোস্টেল সুপারের সংগে সাক্ষাৎ করি। হোস্টেল সুপার মুহতারাম ফখরুদ্দীন আমাকে বললেন, আগে ভর্তি হও অত:পর সিটের জন্য আবেদন কর। ফখরুদ্দীন সাহেবের নিকট থেকে উঠে আসার কথা ভাবছি এমন সময় তিনি আমার দিকে তাকিয়ে একটা মুচকি হাসি দিয়ে বললেন: কোন বিষয়ে কামিল করবেন? বললাম আদব। তিনি বললেন: হাদীস তাফসীর ও ফিকহের চেয়ে আদব কঠিন এবং প্রথম শ্রেণী পাওয়া একটু কষ্টকর হবে। বললাম: স্যার আমার ইচ্ছে আমি কামিল আদবেই ভর্তি হবো। রেজাল্ট যা-ই হোক। কারণ এই ক্লাসের সিলেবাস আর এম এ আরবীর সিলেবাসে যথেষ্ট সামঞ্জস্য আছে।
ঢাকা আলীয়া থেকে আমি ১৯৭৩ সনে কামিল আদব (অনুষ্ঠিত ১৯৭৪) পাশ করি প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান লাভ করে। পূর্বেই উল্লেখ করেছি ঐ সময়ে হোস্টেলের সুপারিনটেনডেন্ট ছিলেন খ্যাতিমান মুহাদ্দিস মাওলানা ফখরুদ্দীন। আমি হোস্টেল ছেড়ে ১৯৭৫ সালের ১লা জুলাই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আরবীর প্রভাষক পদে যোগদান করি এবং ২০১৭ সালে সুদীর্ঘ ৪২ বছরের শিক্ষকতা শেষে অবসর গ্রহন করি।
ঢাকা আলিয়ার জীবন সম্পর্কে আমার অনেক স্মৃতি রয়েছে; কিন্তু এ বিষয়ে কাগজে কলমে কিছু লেখা হয়নি। আজ এই সুযোগ কাজে লাগাতে পেরে মহান আল্লাহর শোকর আদা করছি, অত:পর আমার এক ছোট ভাই ড. ময়নুল হক এর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি যিনি তাঁর শিক্ষক মাওলানা ফখরুদ্দীন সাহেব সম্পর্কে ফেইসবুকে চমৎকার স্মৃতিচারণ করে পরোক্ষভাবে আমাকে এই স্মৃতিচারণ করতে অনুপ্রাণিত করেছেন। আমি আরও আনন্দিত যে মাওলানা ফখরুদ্দীন সাহেবের একজন সুযোগ্য সন্তান জনাব মুহাম্মাদ ইমাদুদ্দীন আমার কাছ থেকে স্মৃতিচারণ মূলক লেখা চেয়ে আমাকে ধন্য করেছেন। সংশ্লিষ্ট সবার জন্য শুভকামনা রইল।
আলীয়ায় ভর্তির পর যথারীতি হোস্টেলে উঠে পড়ি। মাওলানা ফখরুদ্দীন সাহেব এর একাডেমিক কৃতিত্ব বা ক্লাসে পাঠদান সম্পর্কে আমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা নেই, তবে তিনি যে ভাল শিক্ষক ও অভিজ্ঞ প্রশাসক ছিলেন এ কথা ঐ সময়ের সবার কাছেই শুনতাম। আমি ৩২ নম্বর কক্ষে থাকতাম। আমার রুমমেট ছিলেন সাতকানিয়ার কৃতি সন্তান আবুবকর রফীক, আর ফখরুদ্দীন সাহেব কেন যেন রফীক সাহেবকে খুবই সুনজরে দেখতেন, আমিও রফীক সাহেবের মতো মেধাবী ও ভাল মানুষের রুমে থেকে শ্রদ্ধেয় হোস্টেল সুপারের স্নেহের পাত্র ছিলাম।
এখানে আরও একটি কথা আমার স্মৃতিতে ঘুরপাক খাচ্ছে, আলীয়ার প্রিন্সিপাল ড. আইউব আলী স্যারের এক ছেলে জনাব গিয়াস কোন কারণে আমার আগের বছর এম এ আরবি পরীক্ষা স্থগিত করে আমাদের সাথে পরীক্ষার্থী ছিলেন। তাকে সহযোগিতার জন্য স্যার আমাকে বিশেষভাবে বলে দিয়েছিলেন, সুতরাং গিয়াসভাই যখন তখন আমার রুমে আসা যাওয়া করতেন, ফলে হোস্টেল সুপার মাওলানা ফখরুদ্দীন সাহেব সহ অন্যান্যরা মনে করতেন আমি প্রিন্সিপাল সাহেবের খুব কাছের লোক।
মূলত ড. আইউব আলী স্যার সময় পেলে আমাদের আদবের ক্লাসে আসতেন। অফিসের কাজে প্রায়ই ব্যস্ত থাকতেন অথবা মিটিং এ থাকতেন, আমরা আদব ক্লাসে জনাব মুহাম্মাদ আলী নামের (পাবনা) এক শিক্ষক পেয়েছিলাম, জনাব রকীবুদ্দীন সাহেব ও আদবের ক্লাস নিতেন, তবে আমাদের সৌভাগ্য যে আমরা মুহতারাম আলাউদ্দীন আযহারী সাহেবকে বিভাগীয় প্রধান হিসেবে পেয়েছিলাম। শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি টেলিভিশনে আরবী প্রোগ্রাম করতেন এবং আস সাকাফা আল ইসলামী্যাহ নামে একটি আরবি ভাষার মাসিক পত্রিকা সম্পাদনা করতেন।
মাদরাসা আলীয়ার হোস্টেল জীবনে আমি আমার জুনিয়র সিনিয়র অনেকের কাছেই ঈষার্র পাত্র ছিলাম, আর তা সম্ভব হয়েছিল একজন ভালো হোস্টেল সুপারের কারণে।
মুহতারাম ফখরুদ্দীন সাহেব আমার দৃষ্টিতে একজন আদর্শ হোস্টেল সুপার ছিলেন, ছাত্রদের সাধারণত সবচে বড় অভিযোগ থাকে ডাইনিং নিয়ে, আজও নির্দ্বিধায় বলতে পারি, মাওলানা ফখরুদ্দীন সাহেবের যোগ্য দিক নির্দেশনায় আলিয়ার হোস্টেলে জামাই আদরের খাওয়া হত। গোশত-মাছ তো বটেই. আলিয়া হোস্টেলের বর্ডাররা ঘন ডালের জন্য হোস্টেল সুপারকে কৃতজ্ঞতা জানাত।
মুর্শিদ নামে আলীয়া হোস্টেলের একজন প্রহরী ছিলেন, তিনি গাভী পালতেন এবং হোস্টেল চত্বরের ঘাসগুলো গাভীকে খাওয়াতেন। কখনও কখনও গাভী হোস্টেলের ভেতরও নিয়ে আসতেন, ফলে গাভীর গোবরে পরিবেশ দূষিত হচ্ছে এ অভিযোগে মুর্শিদ অভিযুক্ত হয়। আমি সহ কয়েকজন ছাত্রকে হোস্টেল সুপার ডেকে পাঠান, আমরা গাভী এনে পরিবেশ দূষিত করা সমর্থন না করলেও গাভীর জন্য ঘাসগুলো কেটে নিয়ে যাওয়ার সুপারিশ করেছিলাম। কেননা এতে মশা মাছির উৎপাত কম হবে। হোস্টেল সুপার আমাদের সুপারিশে বিষয়টি হালকা করে দেখেন।
উল্লেখ্য যে , ছাত্রদের হোস্টেলে দু তিনজন সিনিয়র মুহাদ্দিস শাইখ আব্দুল বারী, ফজলে হক এবং মিঞা মুহাম্মাদ কাসেমী সাহেব মসজিদের পাশের কক্ষে থাকতেন। আব্দুল বারী সাহেব সাধারণত পাঁচ ওয়াক্ত সালাতে ইমামতি করতেন। ছাত্রদের হোস্টেলে সিনিয়র শিক্ষকরা বসবাস করলে ছাত্ররা বিব্রত বোধ করে এ অজুহাতে তাদেরকে কিভাবে সম্মানজনকভাবে হোস্টেল ছাড়তে বলা যায় এ বিষয়ে কিছু ছাত্র হোস্টেল সুপারকে মৌখিকভাবে জানায়।
যেকোন সমস্যা সমাধানে হোস্টেল সুপার সিনিয়র ছাত্রদের পরামর্শ চাইতেন। আমরা এ নিয়ে তাঁকে পরামর্শ দিয়েছিলাম যে ছাত্ররা যেকোন সময় যেকোন বিষয়ে ঠেকে গেলে সম্মানিত স্যারেরা আমাদের সহায়তা করে থাকেন, কোনমতেই সম্মানিত স্যারদের আমরা হোস্টেল ছাড়তে দিবনা, আর এ মতের ছাত্রদের সংখ্যাই বেশি ছিল। সুতরাং হোস্টেল সুপার এত সহজ সমাধান শুনে খুশি হয়েছিলেন, কারণ সম্মানিত শিক্ষকরা ফখরুদ্দীন সাহেবেরও শিক্ষক ছিলেন।
সাধারণত গান্ধী ক্যাপ মাথায় বিভিন্ন রং এর শেরওয়ানী পরিহিত অপেক্ষাকৃত অল্প বয়সী ফখরুদ্দীন সাহেবকে একজন যুবরাজ মনে হত। চেহারায় তিনি ছিলেন সুদর্শন, প্রতিভাধর একজন ইয়াং মুহাদ্দিস, হোস্টেলের হিসাব নিকেশ সব সময় আপডেটেড থাকত। তাঁর বাংলা লেখাও টাইপের মত মনে হত। নিয়মিত অফিসে আসা এবং দীর্ঘ সময় অফিসে অবস্থানের ফলে হোস্টেলের পরিবেশ যেকোন সময়ের চেয়ে উন্নত ও সুশৃংখল ছিল।
মাওলানা ফখরুদ্দীনের আগে ও পরে কামিলে ১ম স্থান লাভকারীগণ বিশেষত বন্ধুবর আবুবকর রফীক ও শাইখ রকীবরা ফখরুদ্দীন সাহেব সম্পর্কে আমাদের খুব ভালো ধারনা দিতেন। মেধাবীরা মেধাবীদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ এমনটি যদিও বিরল ঘটনা।
মরহুম আলাউদ্দীন আযহারী সাহেবের আস সাকাফা পত্রিকায় আমার কামিলের ফলাফল ছাপা হয়েছিল। এ কথাটি আমি হোস্টেল সুপার মুহতারাম ফখরুদ্দীন সাহেবের কাছে থেকেই জেনেছি। তিনি আমাকে অফিসে ডেকে পাঠিয়ে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন, প্রতিবছরই তো কেউ না কেউ ফার্স্ট পজিশন লাভ করে কিন্তু তোমার শিক্ষক আযহারী সাহেব লিখেছেন:
قد نجح ابو الكلام محمد شس العالم امتحان الكامل (الأديب) وفاق جميع من سبق لمدة ১২ عاما” وكان افتتاح الكامل (الأديب) عام ১৯৬০م
মুহতারাম স্যারের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আমার নিজের ও অন্যান্য শিক্ষকের প্রসংগ এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছি, তবুও পারিনি। আশা করি বিজ্ঞ পাঠক আমাকে ক্ষমা করবেন।
মুহতারাম স্যার যে ইন্তিকাল করেছেন এ কথাটি আমি জানতামনা । এতদিন পর অন্যান্য অগণিত শিক্ষকবৃন্দ হয়তো ইন্তিকাল করেছেন, মরহুম ফখরুদ্দীন সহ আলিয়া ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমার সম্মানিত শিক্ষকদের জন্য রাব্বুল আলামীনের দরবারে মুনাজাত করি।
اللهم اغفر لهم وارحمهم وعافهم واعف عنهم واكرم نزلهم وادخلهم فسيح جناتك الجنة الفردوس ياارحم الراحمين.
লেখক :
এ কে এম শামসুল আলম
অবসর প্রাপ্ত প্রফেসর
আরবি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।