নুর উদ্দিন মোঃ সাদেক হোসাইন
এক সময় (১৯৮৭-৮৮বর্ষে) কামিল ক্লাসে মাদ্রাসায় ই আলিয়া ঢাকায় ভর্তি হলাম হাদিস বিভাগে। প্রথম বর্ষের শিক্ষকরা ও ছিলেন অমায়িক এবং পন্ডিত। সাধারণত প্রথম বর্ষের শিক্ষকের তুলনায় দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষকরা ছিলেন অনেক সিনিয়র এবং অনেক মেধাবী। মাদ্রাসা আলিয়ায় ভর্তি হওয়ার পর দেখি সবাই মাওলানা ফখরুদ্দীন সাহেবের ভক্ত, অনুরক্ত । আমরা তখনও তার কোন ক্লাস পায়নি বলে তার মর্যাদা, শিক্ষা দান পদ্ধতি এবং তার এই জনপ্রিয়তার কারণ বুঝতে পারিনি । সে সময়ে যারা অত্যন্ত দেশ সেরা মেধাবী ছিলেন যেমন জনাব নকীব মোঃ নাসরুল্লাহ, জনাব জাকারিয়া সহ বর্তমানে স্মৃতি থেকে হারিয়ে যাওয়া অসংখ্য মেধাবী ছাত্র, যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ প্রাপ্ত হয়েছিলেন, তারা দেখি যে মাওলানা ফখরুদ্দীন সাহেবের একান্ত ভক্ত এবং অনুরক্ত। প্রথম প্রথম হুজুরের এত জনপ্রিয়তা দেখে খুব হিংসা হতো, মনে প্রশ্ন জাগলো তাঁর এত জনপ্রিয়তা কেন? তখন বুঝতে পারিনি মাওলানা ফখরুদ্দীন কি মাপের মানুষ ছিলেন। দ্বিতীয় বর্ষে সেটা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি, বুঝতে পেরেছি।একজন অতুলনীয় শিক্ষক ছিলেন মাওলানা ফখরুদ্দীন (রহ)। আমার জীবনে আমি অনেক শিক্ষক পেয়েছি, অন্যদের মুখে অনেক শিক্ষকের কথা শুনেছি, কিন্তু ছাত্রদের কাছে ছাত্রদের মতো সহজ বুদ্ধ করে শিক্ষাকে, কোন টপিকসকে উপস্থাপনায় মাওলানা ফখরুদ্দীন হুজুরের মত আর কাউকে আমি পাইনি। একথা সত্যি যে যারা তার কাছে গিয়েছেন, তার সান্নিধ্য পেয়েছেন, তারা সবাই সম্ভবত একই কথা বলবেন যে তিনি শিক্ষক হিসেবে তিনি ছিলেন অনন্য উচ্চ মর্যাদায় অভিষিক্ত। মাদ্রাসায় আলিয়ায় ভর্তির কিছুদিন পর আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগীয় ভর্তি হয়েছিলাম। এখানে আমার তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছে। একজন শিক্ষক একটি সহজ জিনিস কে কত কঠিন এবং কত দুর্বুদ্ধ করে ছাত্রদের কাছে উপস্থাপন করতেন। ছাত্রদের তখন ত্রাহী মধুসূদন অবস্থা। অনেকে তখন ডিপার্টমেন্ট পরিবর্তনের কথা কিংবা ছাত্র শেষ করার চিন্তাও করেছিলেন। যা ছিল মাওলানা ফখরুদ্দীনের সম্পূর্ণ একটি বিপরীত ধারার দুর্বুদ্ধ ধারার উপস্থাপনার কারণে। তখন আমাদের ভালো-মন্দের মধ্যে ফারাক করার বিষয়টি অত্যন্ত সহজ হয়ে গিয়েছিল। তার উপস্থাপনার ধরন ছিল এরকম যে অনেক জটিল কঠিন বিষয়কে ও তিনি সহজবুদ্ধ করে ছাত্রদের সামনে উপস্থাপন করতে পারতেন। কিতাবিজ্ঞানকে ছাত্রদের ভাল ফলাফলের জন্য পরীক্ষার প্রয়োজনের মত করে সাজিয়ে ছাত্রদেরকে উপস্থাপনা করার এক বিরাট কাজ তিনি করে গেছেন তার কর্মজীবনে। তিনি আলোচনায় কিছুটা চট্টগ্রামের আঞ্চলিকতার চাপ ছিল বটে, কিন্তু বাংলাদেশের সমগ্র জেলার ছাত্রদের কাছে সে ভাষা বুঝতে একবিন্দু কষ্ট হয়নি ।অনেক শিক্ষক আছেন যারা ছাত্রদের পরীক্ষা বিমুখ করে রাখতেন। এতে করে অনেক মেধাবী ছাত্র ভালো রেজাল্ট করতে ব্যর্থ হয়। রাখেন আবার অনেক শিক্ষককে দেখেছি যারা শুধু পরীক্ষার মুখী বিদ্যা বিতরণে ব্রত ছিলেন। কিন্তু মাওলানা ফখরুদ্দীনকে দেখেছি একটি অন্য উচ্চতায় ।তিনি জ্ঞান বিতরণের এক অনন্য ধারা অবলম্বন করে গেছেন। তিনি তার স্বভাবসুলভ পদ্ধতিতে জ্ঞান বিতরণ করতেন। কিন্তু মাঝে মধ্যে আমার কাছে মনে হতো পরীক্ষায় যে উত্তরটি ৫ নাম্বারের গুরুত্ব রাখে সেটাকে তিনি পাঁচ নাম্বারের মতো করে উপস্থাপন করতেন, যেগুলো ২০ নাম্বারের গুরুত্ব বহন করে সেগুলো উত্তর তিনি বলার সময় ২০ নম্বরের মত করে বলতেন। অনেক বড় জিনিস তিনি সংক্ষেপ ভাবে বলতে পারতেন। আর উনি অনেক সংক্ষেপ জিনিসকে অনেক সবিস্তারে বলে দিতেন।
মাদ্রাসা আলিয়ার সর্বস্তরের মেধাবী ছাত্রদের কাছে তার আকাশ ছোঁয়া জনপ্রিয়তা তাকে কিছু প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে ফেলে দিয়েছিল সে কথা সবার জানা এবং আমিও এর একজন সাক্ষী। পেশাগত হিংসা বা প্রফেশনাল জেলাসি একজন মানুষকে অনেক কষ্টে অস্বস্তিতে ফেলে দিতে পারে সেটাও আমরা দেখেছি ওনার জীবনে। সে ব্যথায় যেভাবে তিনি ব্যথিত হয়েছেন, আমরা তার চেয়েও বেশি ব্যথিত হয়েছিলাম এই ভেবে যে, মাদ্রাসায় আলিয়ায় তিনি যে অবদান রাখতে পারতেন সারাদেশের ছাত্রদের মধ্যে। সিলেটে বসে সেই অবদান রাখা সম্ভব নয়। সেই আলো গ্রহণ করার বাংলাদেশের এক কোনায় বসে গ্রহণ করার লোক কোথায়।
ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসা ছাত্রদের কাছে এক ছাত্র জনপ্রিয়তার কারণে একসময় তাকে ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসা ত্যাগ করে সিলেটে পোস্টিং দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশের সেরা ছাত্রগুলি কামিল পড়ার জন্য ঢাকায় আসেন এবং আলিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হন ।কিন্তু সে মানে ছাত্র সিলেটের মত একটি জায়গায় পাওয়া ছিল অত্যন্ত দুষ্কর। আর এই কারণে সিলেটে তার ক্ষেত্র প্রস্তুত করা জায়গাটিও ছিল অত্যন্ত কঠিন।
আমি তখন ইসলামী ব্যাংক ছেড়ে প্রাইম ব্যাংকে যোগদান করেছি এবং অফিসের কাজে সাত দিন সিলেটে অবস্থান করেছিলাম সিলেটে অবস্থান করার দ্বিতীয় দিন আমি মাওলানা ফখরুদ্দীন হুজুরের নিকট দেখা করতে গিয়েছিলাম। সে দেখায় আমি কিছু কষ্ট পেয়েছিলাম ।আমি দেখেছিলাম তিনি টিনের ঘরে বাতি নিভিয়ে মাগরিবের আগে একা একা বসে আছেন বাইরের দিকে তাকিয়ে । তাকে এই অবস্থা দেখে আমার মনে অনেক কষ্ট লেগেছিল। তারপর আমি তার সাথে মাগরিবের নামাজ আদায় করে তার রুমে অনেকক্ষণ সময় কাটিয়েছি এবং তার কিছুটা দুঃখ কষ্ট সহ্য অংশীদার হয়ে তার দুঃখ লাঘব করার চেষ্টা করেছি।
মাওলানা জনাব ফখরুদ্দীন ছাত্র জীবনে অথবা কর্মজীবনে তিনি নিজ কর্মস্থলের বাইরে একটি মাদ্রাসার ছাত্রাবাসে রাত্রি যাপন করছিলেন। তিনি একটি খাটের শুয়ে আছেন, আর শুনছেন পাশের দুইজন কামিল ক্লাসের ছাত্র বুখারী শরীফের তাকরীর করছেন। বুখারী শরীফের হাসিয়ায় নিয়ম অনুসারে কোন আলোচনা পূর্বে অতিবাহিত হয়ে গেলে এবং উক্ত প্রসঙ্গটি পরবর্তীতে আসলে সেখানে আরবিতে লেখা থাকতো "মাররা বায়ানুহূ"এর অর্থ হল এর আলোচনার ইতিপূর্বে অতিবাহিত হয়ে গেছে। যদিও ছাত্রদ্বয় কামিল ক্লাসের ছাত্র ছিল । কিন্তু আরবি ভাষার জ্ঞান তাদের তত উন্নত ছিল না, তাই মাররা বায়ানুহু এর স্থলে "মুরুব্বিয়ানোহূ" উচ্চারণ করছিলেন ।আর ফখরুদ্দীন হুজুর পাশের বেডে শুয়ে শুয়ে তা শুনেছিলেন সারারাত ধরে। সেই গল্প আমাদের ক্লাসে একাধিকবার তিনি আলোচনা করেছিলেন। বুখারী শরীফ পড়ানোর সময় যখন এই আলোচনাটি আসতো তখন তিনি এই গল্পের অবতারণা করতেন।
আল্লাহ রাব্বুল আলামিনএই মহান শিক্ষক, মুফাসসির, মুহাদ্দিস একাধারে মুফতি বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী শায়খ আল্লামা ফখরুদ্দীন (রহ) কে জান্নাতুল ফেরদৌস নসিব করুন ।তার পরিবারকে সুরক্ষিত রাখুন। তার আওলাদদেরকে সঠিক ইসলামী তরিকায় জীবন যাপনের এবং আমল করার তাওফিক দিন ।আমীন।
লেখক : ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর, সাউথ ইস্ট ব্যাংক লিমিটেড,প্রধান কার্যালয় ঢাকা।