একজন হাদীস বিজ্ঞানী মাওলানা ফখরুদ্দীন (রহ)
ডক্টর শাহ মুহাম্মাদ আবদুর রাহীম
সরকারী মাদরাসা ই আলিয়া ঢাকা-এর শ্রেষ্ঠ উস্তাজের অন্যতম ছিলেন ফখরুদ্দীন হুজুর । যে সকল হাদীসের উস্তাজের নাম ইতিহাসে পাতায় সোনালী হরফে দেদীপ্যমান ফখরুদ্দীন হুজুর তাঁদের মধ্যে আমার বিবেচনায় শ্রেষ্ঠতর ! তাঁর পাঠদান স্টাইল ও মেথোড ছিলো বিশ্বমানের । তাঁর হাদীস বিজ্ঞানে পারদর্শিতা ব্যুৎপত্তি ও পাণ্ডিত্য ছিলো সুগভীর । তাঁর মতো এমন মাহির আলিম ই দীন খুব কমই দেখা যায় । হাদীসের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ তাশরীহ শরাহ শরূহাত প্রদানের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন খুবই পারংগম ।তাঁর হাদীস পঠন-পাঠনে শব্দ চয়নে ,ব্যবহার ও প্রয়োগে ছিলেন অনুপম ও অনন্য সাধারণ ।ঊর্দু আরবী ও বাংলা শব্দ ভাণ্ডােরে তিনি ছিলেন সমৃদ্ধ । হুজুর এমনভাবে ক্লাসে আসতেন , যেনো কোনো রাজা সগৌরবে কোথাও প্রবেশ করেন । আসলে তিনি তো রাজাই । হাদীস বিজ্ঞানের রাজা । তাঁর ক্লাসে প্রবেশের ভংগি বলে দিতো তিনি কতো ডিটারমাইন্ট । তাঁর হাদীস বিশ্লেষণের স্টাইল ছিলো অনন্য সাধারণ । কোনো ছাত্রই অমনোযোগী থাকার কোনো সুযোগ ছিলো না । এতোই প্রাণবন্ত ছিলো তাঁর ক্লাস । তাঁর ক্লাস চলা কালে যেনো পিনপতন নিরবতা নেমে আসতো । যেনো ফেরেশতা ও জিনরাও শুনতো তাঁর হাদীসের উচ্চাংগের দারস-তাদরীস । প্রতিটি হাদীস পঠিত হতো ।ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ চলতো ।তাশরীহ চলতো - যেনো প্রবাহমান ঝর্ণাধারা স্রোতস্বিনীর মতো । সে কী গভীরতম ব্যাখ্যা , তাশরীহ । কতো রেফারেন্স , কতো নাম না জানা কিতাব , শরাহ-শরুহাত । সেই সকল রেফারেন্সের ব্যক্তিত্ব ও মনীষার দুর্লভ পরিচয় তুলে ধরতেন অনর্গল অভিনব বাচনভংগিতে । যেনো তাঁরা মনে হয় , তাঁর কাছে এসে অমনভাবে বলে গেছেন এখনই । তাঁদের নাম পরিচয় এমন শব্দ ঝংকারে উচ্চারণ করতেন , যেনো মণিমুক্তো মালা জড়ানো কোনো রাজষিক সিংহাসনের অধিকর্তা ।তবে তা মাত্রাতিরিক্ততা বা অতিরন্জনতায় পর্যবসিত হতো না । তাঁদের প্রাজ্ঞতা ও গবেষনা এবং প্রামাণিকতায় বস্তুনিষ্ঠতা রূপায়ন ছিলো অকৃত্রিম ।সে এক অনুপম উপস্থাপনা !
হুজুরের বর্ণনা ছিলো ঝর্ণাধারার মতো প্রবাহমান ও স্বচ্ছ স্ফটিক । হাদীস বিশ্লেষণে মাযহাবী দৃষ্টিকোণ ছিলো সুতীক্ষ্ন খুরধার । প্রতিটি মাযহাবের দৃষ্টিকোণ বিশ্লেষিত হতো তাঁর ব্যাখ্যায় । এমনকী ছোটোখাটো প্রায় সকল ইমাম মুজতাহিদ ও মুহাদ্দিসের বিশ্লেষণও বাদ পড়তো না হুজুরের বিশ্লেষণে । তারপর আসতো তারজীহ (প্রাধান্য)দেওয়ার পালা ।চলতো গহীন থেকে গহীনতর বিশ্লেষণ । দৃষ্টিভংগি পর্যালোচনা । অপরাপর হাদীস এবং সংশ্লিষ্ট কুরআন হাদীসের নস/টেক্ট্স পরীবিক্ষণ । মুজতাহিদ ইমামগণের অভিমত পর্যালোচনা । কেনো হানাফীগণ/ আহনাফ শরীআ পরিপালনে ঐ মত গ্রহণ করেছিলেন তার যৌক্তিক নসভিত্তিক প্রামাণিকতা ।
আজকের প্রেক্ষাপটে যদি হুজুর থাকতেন, তা হলে মাযহাব ও মাযহাবের অকাট্য অনিবার্যতা তুলে ধরতে পারতেন । হানাফী মাযহাব যে কুরআন হাদীস ইজমা কিয়াসের গভীর শেকড়ে গ্রোথিত তা অকাট্যভাবে প্রমাণ করতেন । লা মাযহাবী বা অন্য ফেতনাবাজদের মুখোশ উন্মোচিত করতে পারতেন ।চার মাযহাব বিশেষ করে হানাফী মাযহাব ও ফিকহে হানাফী যে অকাট্য সহীহ দালিলিক ভিত্তির উপর বিনির্মিত মহাপ্রাসাদ তা হুজুরের উপস্থাপনা থেকে সহজেই অনুমিত হতো । সত্যি তিনি ছিলেন হাদীস বিজ্ঞানের চলমান জীবন্ত কিংবদন্তি । তাঁর মতো উস্তাজ আমার জীবনে একজনই - তিনিই মুহাদ্দিস আল্লামা ফখরুদ্দীন।
মাদরাসা ই আলিয়া ঢাকা -উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ দীনী বিদ্যাপীঠ ।কলকাতা আলিয়া মাদরাসা ১৭৮০সালে প্রতিষ্ঠিত হয় । রাজ্যহারা স্বাধীনতা হারা ধন সম্পদ হারা মান সন্মান হারা মুসলিম জনগোষ্ঠির উপর নেমে এসেছিল দু’শো বছরের দাসখতের বেদনাবিধুর ঘোর অমানিশার মহাকাল । বৃটিশ উপনিবেশ আমলে বিশেষ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল কোলকাতা আলিয়া মাদরাসা । ১৯৪৭সালে ভারত পাকিস্তান রাষ্ট্রের উদয় ।তাই ভারত থেকে মুসলিমদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও ভারত থেকে নিয়ে আসতে হলো পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানি ঢাকায় । আজকের বখশীবাজারে সুরম্য অট্টালিকাটি ই সেই মাদরাসা ।মাদরাসা আলিয়ার সবচেয়ে বড়ো বৈশিষ্ট্য হলো এর বড়ো ও সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার । দুর্লভ ও রেফারেন্সমূলক বহু বই-কিতাবে ঠাসা ছিলো গ্রন্থাগারটি । ঐ গ্রন্থাগারের শ্রেষ্ঠ পাঠক ছিলেন আল্লামা ফখরুদ্দীন । তাঁরই অনুপ্রেরণা ও গাইডলাইন পেয়ে আমরাও পাঠ্য কিতাবের আরীআতের (ধার)পাশাপাশি গ্রন্থাগারের বই-কিতাবের সাথে যতসামান্য পরিচয় ঘটে।বই-কিতাবের অমূল্য গন্ধে আমাদের নাসিকা ধন্য হয় ।
তিনি ও তাঁর সময়কার অন্যান্য মহামনীষার অধিকারী শ্রেষ্ঠ শিক্ষকগণের সরগরম পদচারনায় মাদরাসা আংগিনা ছিলো মুখর । আমরাই বাংলাদেশ আমলে ১৯৮১-১৯৮৫ শেসনের ছাত্রগণ কতগুলো দুর্লভ সৌভাগ্যের অংশীদার ছিলাম । এই সময়টায় আলিয়া মাদরসায় অনেক প্রাজ্ঞ গুণীন শিক্ষকগণের সাহচর্য পেয়েছিলাম । আল্লামা ফখরুদ্দীন , আল্লামা উবাইদুল হক (জাতীয় খতীব ), আল্লামা আবদুল হক , আল্লামা মাহবুবুল হক , আল্লামা ওয়াজিহ উদ্দীন , আল্লামা সালাহউদ্দীন, আল্লামা নূর মোহাম্মাদ ,আল্লামা আবদুর রহীম ,মিয়া মুহাম্মাদ কাসেমী ,কসীমুদ্দীন ...রহমতুল্লাহ আলাইহিম আজমাইন প্রমুখ । তাঁরা ছিলেন একঝাঁক জ্ঞানপ্রদীপ । তাঁদের সাথে ফখরুদ্দীন হুজুরের ছিলো ঐকতান । তাঁরা সবাই মিলেই জ্ঞান চর্চা পঠন পাঠনে এনে দিয়েছিলেন প্রাণপ্রবাহ । রাত দিন পঠন পাঠনে তথা সিহাহ সিত্তাহ কিতাবসমূহ পরিপূর্ণভাবে শেষ করার অসামান্য জযবা । সহীহ বুখারী খতম স্বাধীনতাউত্তর ঢাকা আলিয়ায় আমরাই করেছি।এ জন্য দিনের বেলার ক্লাস শেষ করে পুনরায় মাগরিব সালাত শেষে ক্লাসে হাজির হতাম ।আর তা চলতো গভীর রাত পর্যন্ত । খতম মানে শুধু মতন পড়ার খতম নয় । তা গভীর বিশ্লেষণসহ । আমরাই সহীহ বুখারী খতম করে পাগড়ী পেয়েছিলাম । পাগড়ি উপহার পাওয়ার পরম সৌভাগ্যে আমরাই অভিষিক্ত হলাম । এই মহতী উদ্যোগে অন্যতম অবদান রেখেছ্লেন ফখরুদ্দীন হুজুর। আমাদের এই সময় প্রিন্সিপ্যালের দায়িত্বে ছিলেন উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ আলেম আল্লামা ইয়াকুব শরীফ রহ: । তাঁর সময়েই আলিয়া মাদরাসা তার ঐতিহ্যিক গৌরব ফিরে পেয়েছিলো । আমাদের ভর্তি হওয়ার এক বছর আগে আলিয়া মাদরাসা উদযাপন করেছিল দুইশততম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী (১৭৮০-১৯৮০)। এই রেষে ঢাকা আলিয়ায় জড়ো হয়েছিলেন একঝাঁক শ্রেষ্ঠ মনীষা । তাঁদেরই অন্যতম ছিলেন আল্লামা ফখরুদ্দীন । তাঁর আগমন যদি ঢাকা আলিয়ায় না হতো - তা হলে হয়তো ঢাকা আলিয়ার গৌরব ফিরে আসতো না ।
আরেকটি কালো দিক ছিলো বাংলাদেশে পরীক্ষায় নকল প্রবণতা। কিন্তু ফখরুদ্দীন হুজুরের মতো কয়েকজন শিক্ষকের বদৌলতে ঢাকা আলিয়া মাদরাসা ছিলো ১০০% নকলমুক্ত মাদরাসা পরীক্ষা হল । আমরা ছিলাম ঐ সৌভাগ্যবান শিক্ষার্থী পরীক্ষার্থী । মাদরাসা অঙ্গনে সন্ত্রাস ও বিশৃংখলামুক্ত জ্ঞান চর্চাবান্ধব পরিবেশ সুরক্ষায় হুজুরের অবদান ছিলো ।
তিনি যখন সিলেট আলিয়া মাদরসার অধ্যক্ষ ।আমি এবং আমার কলিগ ড.আমির হোসেন সরকার হুজুরকে দেখতে ও দুআ নেওয়ার নিমিত্ত সিলেট সরকারী আলিয়া মাদরাসায় গমন করি । হুজুর তখন আমাদেরকে পেয়ে সত্যি অভিভূত হন । অনেক কথা হয় । জ্ঞান গবেষনা নিয়ে পরামর্শ দেন । আমরা তাঁর স্নেহে যারপরনাই আপ্লুত হই । শিক্ষার্থীদের মধ্য আমরা বেশ কয়েকজন আলোচিত ছিলাম । হাফেজ আবদুল মান্নান হায়দরী, হুজুরের ভাতিজা আমীন ,টুমচর মাদরাসা থেকে আগত হুসাইন আহমদ ,নূরুল হক প্রমুখ । সকলেই নানা অঙ্গনে প্রতিষ্ঠিত ।
ঐ সময়ে হেড মাওলানার দায়িত্বে ছিলেন -শায়খুল হাদীস আল্লামা উবায়দুল হক রহ: । সে সময়টায় মাদরাসা আলিয়া ছাত্র সংখ্যা ছিলো অনেক । পড়া লেখার পরিবেশ ফিরে আসায়ই এমনটা হয়েছিলো ।
মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাঁকে এবং তাঁর মতো উসতাজগণকে আপনার নৈকট্যপ্রাপ্ত বান্দাদের সাথে আপনার সান্নিধ্য রাখুন !
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, ইসলামিক স্টাডিজ , বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় ।
৫ ঘন্টা ১১ মিনিট আগে
৫ ঘন্টা ১৫ মিনিট আগে
৫ ঘন্টা ১৮ মিনিট আগে
৫ ঘন্টা ১৯ মিনিট আগে
৫ ঘন্টা ২৩ মিনিট আগে
৫ ঘন্টা ৪৬ মিনিট আগে
৫ ঘন্টা ৪৯ মিনিট আগে
৭ ঘন্টা ১৭ মিনিট আগে