পৃথিবীতে কিছু মহৎপ্রাণ মানুষ আগমন করেন যাদের পবিত্র হৃদয়স্পর্শে মনীষাপূর্ণ সাহচর্যে জ্ঞানপিপাসু মানুষ খুঁজে পায় আলোর মঞ্জিল, সত্য-সুন্দর পথের দিশা l তারা অন্ধকারে প্রদীপ জ্বালেন, মূর্খপ্রাণে ঢেলে দেন অমৃত জ্ঞানের সুধা l ইলমুল ওহীর শক্তিমত্তায় আর বোধসৌন্দর্যে শুধু নিজেকেই শোভিত করেন না, জ্ঞানপিপাসু হাজার হৃদয়ে প্রজ্জ্বলিত করেন জ্ঞানের মশাল, জাগিয়ে তুলেন মানবতার ঘুমিয়ে থাকা সত্তাকে l
এমনি এক ক্ষণজন্মা জ্ঞানসাধক, শিক্ষাবিদ, বিশিষ্ট আলেমে দ্বীন হজরত মাওলানা ফখরুদ্দীন (রাহি.) l আমার জীবনে যে কজন প্রানপ্রিয় উস্তাদের সাহচর্য পেয়েছিলাম তন্মধ্যে আল্লামা ফখরুদ্দীন অন্যতম l আজ তার তালিম ও বিচক্ষণতাপূর্ণ শিক্ষাদানের সঞ্জীবনী চিত্র আমার হৃদয়পটে এতটুকু ম্লান হয়নি l আমার তৃষ্ণার্ত প্রাণের শক্তি সঞ্চয় করে চলেছে l চলার পথে বেদিশা হলেই পরম শ্রদ্ধাভাজন এ শিক্ষকের উপদেশ যেন সুরক্ষা বাঁধের মতো পথ আগলে দাঁড়ায় l
সিলেট সরকারি আলিয়া মাদ্রাসার অন্যতম ছাত্রনন্দিত অধ্যাপক ছিলেন মাওলানা ফখরুদ্দীন l খ্যাতিমান শিক্ষাবিদ ও সুযোগ্য শিক্ষক হিসেবে তিনি স্বল্প সময়ের ব্যবধানে সবার দৃষ্টি আকর্ষণে সমর্থ হয়েছিলেন l বন্ধুসুলভ আচরণের অধিকারী আমাদের প্রিয় এ শিক্ষক সম্ভবত নব্বই দশকের প্রথম দিকে মাদ্রাসায় জয়েন করেন l ক্লাসে তার অসাধারণ উপস্থাপনভঙ্গি, গভীর জ্ঞানগর্ভ বিশ্লেষণ সবাইকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখতো l আমার খুব কাছে থেকে তাকে দেখার এবং খেদমত করার সৌভাগ্য হয়েছে l ফাজিল ক্লাসে তার কাছ থেকে তাফসীর-হাদিসের পাঠ গ্রহণ করেছি l একজন নিষ্ঠাবান শিক্ষকের সকল গুণাবলী তার মধ্যে বিদ্যমান ছিল l দীর্ঘদিন তার কাছে কোচিং ক্লাস করেছি l আরবি সাহিত্যে ঈর্ষণীয় পান্ডিত্য দেখেছি, যখন এ বিষয়ে তার কাছে প্রাইভেট পড়তাম l
ফাজিলে আলমুন্তাখাবুল আরাবীর প্রশ্নোত্তর তিনি নিজ উচ্চমার্গিয় ভাষায় আমাকে বুঝিয়ে দিতেন এবং আমি নোট করতাম l আদব, ফাসাহাত-বালাগাত-এ সত্যি তার অসামান্য দখল ছিল l পড়ার ফাঁকে ফাঁকে চমৎকার আরবি প্রবাদ ও শিক্ষামূলক উপদেশ আমাকে প্রাণময় করে রাখতো l ব্যক্তিগত অনেক গল্পও করতেন l তখন তিনি মাদ্রাসার কোয়ার্টারে থাকতেন এবং খুব সম্ভব ভাইস প্রিন্সিপালের দায়িত্ব পালন করছিলেন l কিছুদিন পর প্রিন্সিপালের দায়িত্ব গ্রহণ করেন l যেহেতু আমি ভোরে তার কাছে পড়তে আসতাম তাই আমাকে ছুটি দিয়ে তিনি ক্লাসে চলে যেতেন l আমি এ সময় ফাজিল ক্লাসে ইংরেজি ঐচ্ছিক বিষয় নিয়েছিলাম এবং সিলেট আলিয়া মাদ্রাসার এক সময়ের ইংরেজির জনপ্রিয় শিক্ষক হায়াতুল ইসলাম আকুঞ্জী স্যারের কাছে (পরে সিলেট সরকারি কলেজ ও মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ) ক্লাস করতাম l এসব দেখে শ্রদ্ধাভাজন উস্তাদ ফখরুদ্দীন কৌতুক করে আমার সহপাঠীদের বলতেন - ' এ ইংরাজি শিখছে - এ লন্ডন যাইব l'
আমার মরহুম মুহতারাম পিতা সিলেট আলিয়া মাদ্রাসার সাবেক প্রিন্সিপাল শাইখুল হাদিস মাওলানা সাইদুল হাসান রিটায়ার্ড করার পর তিনি জয়েন করেন। কিন্তু আব্বার সাথে তার ঘনিষ্ট যোগাযোগ ছিল l আমাকে বলতেন - 'তুমি তো সাইদুল হাসান সাহেবের এগবারে সর্বশেষ সাহেবজাদা, এগবারে বেশি মায়ার ছেলে l'
তার কাছে প্রাইভেট পড়ার সময় আমি মাঝে-মধ্যে জ্বরে আক্রান্ত হতাম l কিন্তু অসুস্থতা নিয়েও ক্লাসে আসতাম l কারণ তার হৃদয়গ্রাহী ও আকর্ষণীয় পাঠদানের লোভ সামলাতে পারতাম না l আমি সাধারণত হোমিওপ্যাথিক ঔষধের ভক্ত l আলাপ প্রসঙ্গে আমি জ্বরের জন্য হোমিও ঔষধ সেবন করি কারণ এলোপ্যাথিক ঔষধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া বেশি ও পাওয়ারফুল একথা বললে জনাব বলতেন, 'এলোপ্যাথিক ঔষধ খাইয়া তাড়াতাড়ি সুস্থ ০অইজিবাগৈ...পাওয়ারফুল কিতাগৈ l' তার কথায় একধরণের সততাপূর্ণ কৌতুক মেশানো ছিল যা আমাকে মানসিকভাবে আপ্লুত করতো l
ছাত্রদের সাথে তার আচরণ ছিল অনেকটা বন্ধুভাবাপান্ন l হাস্যকৌতুক ছিল তার একটা অপূর্ব কৌশল যার মাধ্যমে তিনি সহজেই শাসন ও আনন্দদান এ দুটোর মেলবন্ধন ঘটিয়েছিলেন l এ কারণে তার কোনো কথায় কেউ বিরক্তিবোধ করতো না l আমাকে পড়ানোর সময় শ্রদ্ধ্বেয় জনাব প্রায়ই বলতেন যে, তার নামের সাথে মিল আছে এমন একজন প্রিয় ছাত্র খুবই মেধাবী l একইসাথে মাদ্রাসা ও ইউনিভার্সিটিতে পড়ছে। অথচ তিনি অন্য কোনো শিক্ষার্থীর ব্যাপারে একই সাথে মাদ্রাসা ও কলেজে পড়া পছন্দ করতেন না l এ ঘটনা থেকে হয়তো তিনি এটাই বুঝাতে চাইতেন- অসাধারণ মেধাবী ছাড়া কোনো শিক্ষার্থী দুটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একই সঙ্গে কৃতিত্ব অর্জন করতে পারবে না l বলতে দ্বিধা নেই, তার দূরদর্শী চিন্তা অত্যন্ত প্রখর ছিলো l হাদিসের ক্লাসে শিক্ষার্থীরা তার জ্ঞানগর্ভ আলোচনা তন্ময় হয়ে শুনতো l আমাকে পড়ানোর সময় তিনি আরেকটি বিষয়ে সব সময় উপদেশ দিতেন l আরবি একটি শ্লোক পাঠ করে বলতেন- যে স্থান থেকে যে জিনিস কাজের জন্য সরিয়ে নিবে, কাজ শেষ করে তা যথাস্থানে আবার যেন রাখতে ভুল না হয় l কী গভীর প্রজ্ঞাসুলভ নির্দেশনা l তার কার্যকালীন সময়ে মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার মানোন্নয়নে তিনি বিশেষ নজর দিতেন l ক্লাসের পাঠ ছাড়াও ব্যক্তিগত আচার-ব্যবহার, সিদ্ধান্ত গ্রহণে বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিতে তাকিদ দিতেন l শরীয়াতের গুরুত্বপূর্ণ মাসআলা, দ্বীনি দৃষ্টিভঙ্গির মৌলিক অকাট্যতা বিষয়ে কঠোরতা তার আলোচনা থেকে পরিস্ফুটিত হয়ে ওঠতো l আদব-আখলাকে সর্বদা বিনম্র ও সততার উপর প্রতিষ্ঠিত থাকতে গুরুত্ব প্রদান করতেন l মাওলানা ফখরুদ্দিন রাহিমাহুল্লাহর এরকম ব্যতিক্রমী গুণাবলী বিদ্যমান ছিল যা শিক্ষার্থীদের প্রবলভাবে আকৃষ্ট করতো l
তার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আজ এরকম উস্তাদ ও শিক্ষাবিদের অভাব খুব বেশি অনুভব করছি l তার মতো নিষ্ঠা ও খুলুসিয়ত কিংবা আন্তরিকতার উদাহরণ আজকাল বেশি পরিলক্ষিত হয় না l সততা ও নিঃস্বার্থ শিক্ষা দান, দ্বীনের উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা হাতে মানবতার সেবায় তিনি যে অবদান রেখেছেন ; অসংখ্য আলেম তৈরির মধ্য দিয়ে যে খেদমত আঞ্জাম দিয়ে গেছেন তা আমাদের অন্তঃকরণে এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে l
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তার দ্বীনের সকল খেদমত কবুল করে নিন এবং তাকে জান্নাতের উঁচু মাকামে দাখিল করুন - আমীন l
লেখক :
কবি-প্রাবন্ধিক
শিক্ষক- ম্যানহাটান বাংলা-সাংস্কৃতিক স্কুল,
নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র।