১০, ২০, ৫০ বছর আগের কথা ভাবুন। মানুষে মানুষে সম্পর্কটা কতই না মধুর ছিল। যৌথ পরিবারে আনন্দের কমতি ছিল না। কিন্তু ধীরে ধীরে মানুষের মধ্যে বিবাদ বাড়ছে। ফলে আপনও পর হয়ে যাচ্ছে। কাছের মানুষগুলো দূরে সরে যাচ্ছে। ঠিক তেমনি চাঁদের কথা বলা যায়। একসময় কাছে অবস্থান করা ‘বন্ধ’ চাঁদ আজ পৃথিবী থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। চাঁদের কারণেই দিনের দৈর্ঘ্য বেড়েই চলছে। সামান্য আকারে দিনের মেয়াদ বাড়ে বলে কাজের ব্যস্ততায় হয়তো আমরা টেরই পাই না। বরং আরো বলি যে, কীভাবে দিনটা চলে গেল, টেরই পেলাম না। কিন্তু একটা সময় আসবে যখন দিন আর ফুরাবে না।
জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের মতে, সাড়ে ৪০০ কোটি বছর আগে জন্ম হয়েছিল পৃথিবীর। এই ধরণীর একমাত্র উপগ্রহ চাঁদের সৃষ্টি হয়েছিল আরো ৫০ কোটি বছর পর (সৌরজগতের জন্মের ৫ কোটি বছর পর)। কোটি কোটি বছর আগে পৃথিবীতে দিনের গড় দৈর্ঘ্য ছিল ১৩ ঘন্টারও কম। কিন্তু এখন তা বেড়েই চলছে। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়্যাল হলওয়ের ভূ-পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক ডেভিড ওয়ালথামের মতে, দিন বড় আর রাত ছোট হওয়ার জন্য দায়ী চাঁদ। এসবই হয় জোয়ার-ভাটার কারণে। সর্বশেষ বিশ্লেষণ অনুসারে, পৃথিবীতে গড়ে দিনের দৈর্ঘ্য ১ দশমিক শূণ্য ৯ মিলিসেকেন্ড বৃদ্ধি পাচ্ছে।
কারো কারো মতে, ১ দশমিক ৭৮ মিলিসেকেন্ড। এমন হারে বাড়তে সময় লেগেছে ৪০৫ কোটি বছর। জার্মানির ফ্রিডরিচ শিলার ইউনিভার্সিটির ভূ-পদার্থবিদ টম ইউলেনফেল্ড জানান, চাঁদ অতীতে আজকের তুলনায় পৃথিবীর হৃদয়ের অনেক কাছাকাছি ছিল। ধারণা করা হয়, পৃথিবীতে একসময় সম্ভবত প্রতি ২৪ ঘণ্টায় দুটি সূর্যোদয় এবং দুটি সূর্যাস্তের ঘটনা ঘটত। এর ফলে দিন এবং রাতের তাপমাত্রার পার্থক্য হ্রাস করতে পারে এবং সালোকসংশ্লেষকারী জীবের জৈব রসায়নকে প্রভাবিত করতে পারে।
পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্ব ছিল তখন মাত্র সাড়ে ২২ হাজার কিলোমিটার বা ১৪ হাজার মাইল। অথচ আমাদের এই গ্রহের উত্তর মেরু থেকে দক্ষিণ মেরুর দূরত্ব ১২ হাজার ৪৩০ মাইল। অর্থাৎ চাঁদ সেক্ষেত্রে মাত্র দেড় হাজার মাইল বেশি দূরে ছিল।
সরতে সরতে চাঁদ এবং পৃথিবীর দূরত্বের ব্যবধান ৩ লাখ ৮৪ হাজার ৪০০ কিলোমিটার (২৩৮,৮৫৫ মাইল)। অথচ জন্মের সময় চাঁদ এবং পৃথিবীর মধ্যকার দূরত্ব ছিল ২ লাখ ৭০ হাজার কিলোমিটার (১৭০,০০০ মাইল)। জন্মের সময় সন্তান বাবা-মায়ের যত কাছাকাছি থাকে, কিন্তু সন্তান যত বড় হয় ততই যেন দূরে চলে যায়। চাঁদ এবং পৃথিবীর সম্পর্কটাও যেন তেমন গতিতে চলছে। আর্জেন্টিনার ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সাল্টার ভূতাত্ত্বিক ভ্যানিনা লোপেজ ডি আজারেভিচের একটি সমীক্ষা বলছে, ৫৫০-৬২৫ মিলিয়ন বছর আগে চাঁদ বছরে ২ দশমিক ৮ ইঞ্চি বা ৭ সে.মি পিছিয়ে যেতে পারত।
অবস্থাটা এমন যে পার্থিব দিন আগের চেয়ে অনেক বড় হয়ে গেছে। সাড়ে ৪০০ কোটি বছর আগে যখন অনেক জোরে ঘুরত পৃথিবী। তখন দিনের ব্যাপ্তি ছিল মাত্র ২৩ হাজার সেকেন্ড বা সাড়ে ৬ ঘণ্টার। ৩০০ কোটি বছর আগে পৃথিবীর গতি আরো কমে দিনের আয়ু বেড়ে হয় ৮ ঘণ্টা। ৬২ কোটি বছর আগে দিনের মেয়াদ ছিল ২২ ঘণ্টার। আর এখন সেটা ২৪ ঘণ্টা। ৬৫ কোটি বছর পর দিনে হবে ২৭ ঘণ্টার। অর্থাৎ যত দিন যাবে, এই সময় আরো বাড়তে থাকবে।
সূর্য ও চাঁদ পৃথিবীকে আকর্ষণ করে। তবে পৃথিবীর ওপর সূর্য অপেক্ষা চাঁদের আকর্ষণ বল বেশি। কারণ সূর্যের ভর চাঁদের ভরের চেয়ে কম হলেও সূর্যের চেয়ে পৃথিবীর অনেক কাছে অবস্থান করে চাঁদ। তাই চাঁদের আকর্ষণেই প্রধানত সমুদ্রের পানি ফুলে ওঠে ও জোয়ার হয়।
পৃথিবী ও চাঁদের ঘূর্ণনের কারণে চাঁদ পৃথিবী থেকে দূরে সরে গেলে, ফুলে ওঠা পানি আবার নেমে যায়, যা ভাটা হিসেবে পরিচিত। বিজ্ঞানীরা জানান, জোয়ারের টান চাঁদের ঘূর্ণনকে ধীর করে দেয়। তাই চাঁদ নিজের কক্ষপথের অনেক উঁচুতে উঠে যাচ্ছে। ফলে পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্ব বাড়ছে। অ্যাপোলো মিশনের মহাকাশচারীরা নিশ্চিত করেছেন যে, চাঁদ প্রতি বছর ১ দশমিক ৫ ইঞ্চি (৩ দশমিক ৮ সেমি) হারে দূরে সরছে। এর প্রভাব পড়ছে পৃথিবীর ওপর। কারণ চাঁদ ক্রমশ দূরে সরে যাওয়ায় পৃথিবীও ধীরে ধীরে ঘুরছে।
অ্যারিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের লুনার অ্যান্ড প্ল্যানেটারি ল্যাবরেটরির প্রফেসর বিষ্ণু রেড্ডি জানিয়েছিলেন, বছরে আমাদের হাতের নখ যতটা বাড়ে, প্রত্যেক বছরে চাঁদ ঠিক ততটা দূরত্বই সরে যাচ্ছে পৃথিবী থেকে। এর জেরে নিজের চারদিকে ঘুরতে পৃথিবীর প্রতি বছর ১৪ মাইক্রো সেকেন্ড করে সময় বেশি লাগছে। সেজন্যই পৃথিবীর ঘড়িকে আপডেটেড রাখতে ১৮ মাস অন্তর যোগ করতে হয় ‘লিপ সেকেন্ড।’ অধ্যাপক রেড্ডির মতে, ৬৫ কোটি বছর পর চাঁদ পৃথিবীর থেকে যে দূরত্বে পৌঁছে যাবে, সেখান থেকে তার পক্ষে আর সূর্যের মুখ ঢাকা সম্ভব হবে না।
চাঁদ আমাদের সঙ্গ ছেড়ে দূরে চলে যাওয়ায় ইতিমধ্যেই আমাদের গ্রহে পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণের সংখ্যা কমতে শুরু করেছে। চাঁদ যত দূরে চলে যাবে, ততই কমতে থাকবে পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণের সংখ্যা। খণ্ডগ্রাস আর বলয় গ্রাস সূর্যগ্রহণ বাড়বে। চাঁদের কারণেই পূর্ণিমা আর অমাবস্যা হয়। গোবরের পোকা জীবন বাঁচাতে চাঁদের আলোকেই ব্যবহার করে। চাঁদের কারণেই ক্যালেন্ডারের সৃষ্টি। চাঁদ অনেক দিক দিয়েই আমাদের বন্ধু। তাই বন্ধুর সঙ্গে বিচ্ছেদে মূল্য দিতে হবে সূর্যের তাপে পুড়ে।
২ ঘন্টা ১৩ মিনিট আগে
২ ঘন্টা ৪৫ মিনিট আগে
৩ ঘন্টা ১৭ মিনিট আগে
৩ ঘন্টা ২৩ মিনিট আগে
৩ ঘন্টা ৪৪ মিনিট আগে
৩ ঘন্টা ৪৬ মিনিট আগে
৪ ঘন্টা ৬ মিনিট আগে
২১ ঘন্টা ৪৫ মিনিট আগে