|
Date: 2023-04-14 15:08:07 |
বাংলার ঘরে ঘরে আবার বৈশাখের ডাক। আবার ঢাক-ঢোলের হাঁক। অলিতে গলিতে আবার সেই লাল-সাদা শাড়ির ঝিলিক। আবার সেই পান্তা-ইলিশের হিড়িক। মাঠে মাঠে আবার সেই বৈশাখী মেলা। সেই বায়োস্কোপ, সাপ-লাঠি খেলা। হৃদয়ের অলিন্দ-নিলয়ে আবার সেই ‘মেলায় যাই রে’ গান। রমনার বটমূলে ফের প্রভাতফেরির তান। রাজপথে আবার সেই মঙ্গল শোভাযাত্রার পদধ্বনি। আবার সেই দৈত্যাকার হাতি-ঘোড়া, একতারা-খঞ্জনি। সব মিলিয়ে বাংলার দিকে দিকে পয়লা বৈশাখের সাত রং।
তবে তাত্পর্য, গৌরব ও বিস্তার বিচারে পয়লা বৈশাখের অবস্থান এখন একটু ভিন্ন। তার কারণ ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’। পয়লা বৈশাখের এই অবিচ্ছেদ্য অংশ ও অন্যতম প্রধান উৎসবটি এখন আর শুধু বাংলাদেশের নয়; এটি এখন বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ ‘স্পর্শাতীত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য’। এই গৌরবোজ্জ্বল বিশ্বস্বীকৃতির পর এবার দ্বিতীয় বারের মতো পয়লা বৈশাখ এবং মঙ্গল শোভাযাত্রা উদ্যাপিত হচ্ছে। যতদূর জানি, নববর্ষকে ঘিরে, সবার মঙ্গল কামনায়, এরূপ ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ আর কোথাও আয়োজন হয় না। এই মৌলিক সংস্কৃতির কপালে বিশ্বস্বীকৃতির এমন রাজটীকায়, বাংলা পয়লা বৈশাখটি নিঃসন্দেহে অন্য মাত্রিক ব্যঞ্জনা ও উচ্চতা নিয়ে আমাদের সামনে হাজির হচ্ছে।
তবে মঙ্গল শোভাযাত্রার এই বিশ্বজয়ের পথটা খুব একটা ছোট নয়। ৩৬ বছর আগে এর যাত্রা। উৎসবটির ব্যাপক পরিচিতি ও প্রসারটা ঢাবির চারুকলা ইনস্টিটিউটের মাধ্যমে। তবে এর শুরু যশোরের ‘চারুপীঠ’ নামের এক সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে।
তখন ১৯৮৫ সালে। সাম্প্রদায়িক সামরিক শাসনের রোষানলে রাজনৈতিক অঙ্গনে তখন ঘোর অমানিশা। শিল্প-সংস্কৃতির অঙ্গনেও মুমূর্ষু দশা। এই বন্দিদশায় একটুখানি ‘খোলা হাওয়া’ পাওয়ার আশায় চারুপীঠের কর্মীরা এমন একটা অসাম্প্রদায়িক সাংস্কৃতিক আয়োজনের পরিকল্পনা করল, যা দিয়ে দেশীয় সব শিল্পকে একসঙ্গে মেলানো যাবে এবং সবার প্রাণকে একই সুরে বাঁধা যাবে। এই ভাবনা থেকে সে বছর একুশে ফেব্রুয়ারিতে প্রভাতফেরির পর, যশোরের রাজপথে বের করা হলো বর্ণিল ও সুসজ্জিত এক শোভাযাত্রা। সেখানে বাহারি রং আর নানা উপকরণ দিয়ে তুলে ধরা হলো ভাষা আন্দোলনের অর্জন আর বাঙালির আবহমান সংস্কৃতির বিভিন্ন দিক। শোভাযাত্রাটি যশোরবাসীর বেশ ভালো নজর কাড়ে। তাতে চারুপীঠের কর্মীরা চিন্তা করল, অসাম্প্রদায়িক ও সর্বজনীন উত্সবই যদি পালন করবে, তবে সেটা পয়লা বৈশাখের দিন নয় কেন? যেই ভাবা সেই কাজ। সিদ্ধান্ত হলো পরের বছর ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’ হিসেবেই তারা আরো বড় পরিসরে অনুষ্ঠানটি করবে।
শুরু হলো ব্যাপক প্রস্তুতি। কর্মীদের কেউ বানাল বিচিত্র মুখোশ, কেউ বানাল পাখি, পরি, প্রজাপতিসহ বিচিত্র প্রতিকৃতি। শিশুদের জন্য বানানো হলো সুন্দর সুন্দর মুকুট। নৃত্য, নাট্য, সংগীতসহ সব শিল্পকে এক প্লাটফর্মে মেলানোর লক্ষ্যে ৩০০ ছেলেমেয়ে নিয়ে টানা এক মাস চলল নাচগানের মহড়া। অবশেষে ঘনিয়ে এল পয়লা বৈশাখ (১৯৮৬ সাল)। ওই দিন সকাল ছ’টায় সানাই বেজে উঠল। বেজে উঠল আরো নানা দেশীয় যন্ত্রানুষঙ্গ। মুহূর্তেই মুখর হয়ে উঠল যশোরের সরকারি মাইকেল মধুসূদন কলেজ অঙ্গন। ঢুলি আর অন্যান্য যন্ত্রীদের সঙ্গে একজন-দুজন করে সমবেত তরুণরা শরীর দুলাতে শুরু করল। কিছু সময় এভাবে কাটল। ওদিকে বাদ্যযন্ত্রের গগনবিদারী আওয়াজ ও অনুপম তালে ঘরে থাকা দায়। তাতে আশপাশ থেকে হই হই করে লোকজন জড়ো হতে লাগল। তারপর শুরু হলো পাপেট, বাঘের প্রতিকৃতি, পুরনো বাদ্যযন্ত্র, লোকজ বিভিন্ন অনুষঙ্গ ও শিল্পকর্মসহ শহর পরিভ্রমণ। ততক্ষণে আনন্দ বার্তা ছড়িয়ে পড়ল চারপাশে। শোভাযাত্রায় নতুন জামা-কাপড়ে, সেজে-গুজে যোগ দিতে লাগল আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা। নববর্ষ উদযাপনের এমন অভিনব আয়োজনে সাজ সাজ রব পড়ে গেল গোটা শহরে। সেই যাত্রায় কৌতূহল-উদ্দীপনায় উজ্জীবিত যশোরবাসী টানা দুই-আড়াই ঘণ্টা দলবেঁধে ছুটল নেচে গেয়ে। তারপরও ক্লান্তি নেই। সেই শুরু। তারপর প্রতি বছর একই আনন্দযাত্রা। সেই আনন্দ শোভাযাত্রার ঢেউ যশোর ছাড়িয়ে আছড়ে পড়ল ঢাকায়। তিন বছর পর একই উদ্দেশ্যে, একই ঢংয়ে, একই নামে শোভাযাত্রা শুরু হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে। অনুষদের শিক্ষার্থী-শিক্ষকদের নিয়ে আয়োজিত এই শোভাযাত্রাটি প্রথম বছরই সাড়া ফেলে দেয়। গণমাধ্যমের কল্যাণে তা ব্যাপক প্রচারও পায়। ছড়িয়ে পড়ল অন্যান্য জেলাতেও।
দিনে দিনে বাড়ল তার পরিসর ও জনপ্রিয়তা। দশম বছরে (১৯৯৬) আনন্দ শোভাযাত্রাটি নাম নিল ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’। আয়োজনটি সর্বমহলে এতটা গ্রহণযোগ্যতা পায় যে, ২০ বছরের মাথায় শোভাযাত্রাটি ‘বাংলাদেশের জাতীয় সংস্কৃতি’ হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পায়। আর ৩০ বছরের মাথায় মিলল বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ ‘সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য’ এর মুকুট।
জাতিসংঘের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও বিজ্ঞানবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকো ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর এই স্বীকৃতি দেয়। কারণ হিসেবে ইউনেসকো উল্লেখ করে, ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা অশুভকে দূর করা, সত্য ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির প্রতীক। এই শোভাযাত্রার মাধ্যমে বাঙালির ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, জাতিগত সব ধরনের বৈশিষ্ট্য এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মের কাছে হস্তান্তরিত হয়’। এর আগে ২০০৮ সালে বাংলাদেশের বাউল গান ও ২০১৩ সালে জামদানি শাড়ি একইভাবে ‘স্পর্শাতীত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য’ হিসেবে স্বীকৃতি পায়।
নতুন বছরে সামরিক শাসনের বিরূদ্ধে সাধারণ মানুষের ঐক্য, একই সঙ্গে শান্তির বিজয় ও অপশক্তির অবসান এবং বাংলাদেশের মানুষের কল্যাণময় ভবিষ্যতে কামনায় শুরু হয়েছিল মঙ্গল শোভাযাত্রার ‘শুভ যাত্রা’। এখন সামরিক শাসনের ত্রাস নেই। আছে অগ্নি-দুর্ঘটনার ত্রাস। আছে কিশোর গ্যাংসহ বিচিত্র সন্ত্রাসবাদের ত্রাস। আছে রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতির বিষবাষ্পের ত্রাস। আছে দ্রব্যমূল্যের লাগাতার ‘উল্কাগতি’র ত্রাস। সত্যি বলতে কি, বাজারে দামের আগুনে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস অবস্থা। সঙ্গে চালকদের বেপরোয়া যান চালনায় প্রতিদিন অস্বাভাবিক মৃত্যুর হাতছানি তো আছেই। সকল অস্বাভাবিক মৃত্যু, অপ্রতিরোধ্য অশুভ শক্তির অবসান ও মুক্তি কামনায় শুরু হোক এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রা। জনজীবনে সর্বাঙ্গীন শান্তি, স্থিতি ও নিরাপত্তা কামনায় শুরু হোক এবার নববর্ষের পথচলা।
© Deshchitro 2024