মানব জীবন রক্ষা ও জীবন উন্নয়নের জন্য শিক্ষা একটি মুখ্য হাতিয়ার। আবার শিক্ষা, নিজেদের মধ্যে ভাব-ধারণা,কৃষ্টি,সংস্কৃতি, প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞতা আদান-প্রদান করার মাধ্যম এবং উত্তরসূরীদের নিকট ঐতিহ্য হস্তান্তর করার বাহন। শিক্ষার পরিণত ফল হল সভ্যতা, যা মানুষকে পশুত্বের স্তর থেকে মানব সত্তায় উন্নীত করে। শিক্ষা বিহীন মূর্খ লোক পশুর সমান ও নিকৃষ্ট প্রাণী। আর ইসলামী শিক্ষাই হচ্ছে সর্বোত্তম শিক্ষা। ইসলামী শিক্ষার প্রধান উৎস হচ্ছে- পবিত্র কোরআন ও রাসুল (সা.) এর সুন্নাহ। পবিত্র কোরআন এবং হাদিসে ইলম অর্জন এবং শিক্ষাদানকারীর জন্য অগণিত মর্যাদা বর্ণিত হয়েছে। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি এমন পথে গমন করে; যাতে সে বিদ্যা অর্জন করে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাতের রাস্তা সহজ করে দেন।’ (মুসলিম : ২৬৯৯)।
সারাবিশ্বে বর্তমানে হতাশাগ্রস্থ মানুষের কছে যখন শান্তির নামে অশান্তিতে ভরে তুলেছে তখন বিশ্ববাসী আজ আগ্রহ প্রকাশ করেছে ইসালামী জীবন ব্যবস্থাকে মানার জন্য । তাই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ইসালমী অর্থনীতি, সমাজনীতি, রাজনীতি বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে । আর এক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ হিসেবে ইসলামিক স্টাডিজের ভূমিকা অগ্রগণ্য ।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৭৭ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর মাসে আরবি ও ফার্সি বিভাগ নামে যাত্রা শুরু হয়। তবে এর আগে "প্রাচ্য ভাষা" বিভাগের অধীনে ছিল। প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে প্রফেসর ড. এম এ গফুর (১৯৭৭-১৯৮০) বিভাগীয় প্রধান নিযুক্ত হন। পরবর্তীতে ড. এ এম শরফুদ্দীন (১৯৮০-১৯৮৩), প্রফেসর ড. এম এম আব্দুল গফুর চৌধুরী (১৯৮৩-১৯৮৬), প্রফেসর ড. মুহাম্মদ রশিদ (১৯৮৬-১৯৮৯), ড. মুফিজ উদ্দীন (১৯৮৯-১৯৯২), প্রফেসর ড. আনোয়ারুল হক খতিবী (১৯৯২-১৭/০৯/১৯৯৫) পর্যায়ক্রমে বিভাগীয় সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। বিভাগের নাম "আরবি ও ফার্সি" হলেও ফার্সি পড়ার মত কোন শিক্ষার্থী না থাকায় এই বিষয়ে কোন কিছু সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত ছিলো না। ফলে বিভাগের শিক্ষকবৃন্দ ফার্সি স্থলে ইসলামিক স্টাডিজ বিষয়ে পাঠদানের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। বিভাগীয় একাডেমিক কমিটির বৈঠকে ইসলামিক স্টাডিজ বিষয় অন্তর্ভুক্ত করার সর্বসম্মত সুপারিশ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের কাছে পেশ করা হয়। প্রশাসনের সার্বিক সহযোগিতায় "আরবি ও ফার্সি" অধীনে ১৯৮৮-১৮৮৯ সেশন আরবি খ হিসেবে ইসলামিক স্টাডিজ বিষয়ে ভর্তি করানো হয়। অনার্স ১ম বর্ষ ও ২য় বর্ষ আরবি "খ" নামে ইসলামিক স্টাডিজের মার্কশীট ও ফলাফল তৈরী করা হয়। বিভাগীয় শিক্ষকদের অনুপ্রেরণায় শিক্ষার্থীরা আরবি খ এর স্থলে ইসলামিক স্টাডিজ লিখা ও স্বতন্ত্র বিভাগ খোলার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে জোর দাবী পেশ করেন। দাবী বাস্তবায়নের নিমিত্তে শিক্ষার্থীরা সভা-সমাবেশ, মিছিল-মিটিং,মানববন্ধন, স্মারকলিপি প্রভৃতির মাধ্যমে জোরালো আন্দোলন করতে থাকে। যার ফলশ্রুতিতে ১৮-০৯-১৯৯৫ তারিখে অনুষ্ঠিত সিন্ডিকেট সভায় "আরবি ও ফার্সি " এর স্থলে "আরবি ও ইসলামিক স্টাডিজ" নামকরণ করা হয় এবং ইসলামিক স্টাডিজ বিষয়ে অনার্স ও মাস্টার্স ডিগ্রীর সার্টিফিকেট দেয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ফলে প্রফেসর ড. আনোয়ারুল হক খতিবী (১৮/০৯/১৯৯৫-২৬/০৯/১৯৯৫) ০৯ দিন বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে ড. এফ এম আমিনুল হক (২৭/০৯/১৯৯৫-১৯৯৮), ড. রফিক আহমদ (১৯৯৮-২০০১), ড. হাফেজ মুহাম্মাদ বদরুদ্দোজা (২০০১-২০০৪), ড. আ ক ম আব্দুল কাদের (২০০৪-২৫/০৫/২০০৫) পর্যায়ক্রমে বিভাগীয় সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।
২৬/০৫/২০০৫ তারিখ থেকে আরবি বিভাগ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে "ইসলামিক স্টাডিজ " নামে কলা অনুষদের অধীনে নব উদ্যোমে পথচলা শুরু করে। চট্টগ্রামের সূর্যসন্তান ড. আনোয়ারুল হক খতিবীর অক্লান্ত পরিশ্রম ও প্রচেষ্টায় ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ প্রতিষ্ঠা করে প্রতিষ্ঠাতা সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ইসলামিক স্টাডিজ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ছিলো শিক্ষার্থীদেরকে মানুষরূপে গড়ে তোলা। যে শিক্ষা আত্মপরিচয় দান করে, মানুষকে সৎ, সাহস,দক্ষ ও সুনাগরিক হিসেবে গঠন করে এবং পরোপকারী, কল্যাণকামী ও আল্লাহর প্রতি অনুরাগী হতে সাহায্য করে, সে শিক্ষাই প্রকৃত শিক্ষা। সেই ধারাবাহিকতায় প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এ বিভাগের শিক্ষার্থীরা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে।
ইসলামিক স্টাডিজ বিষয়টি শুধু মাদ্রাসা এবং মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থীদের জন্য সীমাবদ্ধ নয়। এটি স্কুলের বিজ্ঞান, ব্যবসায় শিক্ষা এবং মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থী সবাই সমভাবে পড়তে পারে। আল কুরআন ও তার প্রখ্যাত তাফসীর গ্রন্থাদি উলুমুল কুরআন,উলুমূল হাদীস, সিহাহ সিত্তাহ,মুসলিম বিশ্বের ইতিহাস, ফিকহ গ্রন্থাদি, ইসলামী অর্থনীতি,রাষ্ট্রনীতি,ইসলামে ব্যাংকিং পদ্ধতি, ইসলামের সমাজ, পরিবার ব্যবস্থা, রাষ্ট্রব্যবস্থা, রাজনীতি, হিউম্যান রাইটস, ইসলামিক বিধান, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, ইসলাম ও অন্যান্য মতবাদের তুলনামূলক আলোচনা ইত্যাদি বিষয় ইসলামিক স্টাডিজে পড়ানো হয়।
প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে বর্তমান পর্যন্ত বিভাগীয় সভাপতির দায়িত্ব পালনে নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন যারা।
প্রফেসর ড. আনোয়ারুল হক খতিবী (রহ):
বাংলাদেশের আরবী ও ইসলামী শিক্ষায় উজ্জ্বল নক্ষত্র চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামী স্টাডিজ বিভাগের প্রবীণ শিক্ষক প্রফেসর ড. আনোয়ারুল হক খতিবী (রহ) একজন সফল শিক্ষাবিদ এবং ইসলামী চিন্তাবিদ ছিলেন। চট্টগ্রাম জেলার লোহাগাড়া থানার পশ্চিম কলাউজান গ্রামের প্রসিদ্ধ খতীব পরিবারে জন্ম তাঁর। ১৯৭৯ সালে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবী ও ফার্সী বিভাগে প্রভাষক পদে যোগদান করেন। ক্রমাগতভাবে পদোন্নতি পেয়ে তিনি ১৯৯২ সালে উক্ত বিভাগের সভাপতির দায়িত্ব কৃতিত্ব সহিত নিবিড়ভাবে পালন করেন। পরবর্তীতে চট্টগ্রামের এই সূর্যসন্তানের অক্লান্ত পরিশ্রম ও প্রচেষ্টায় ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ প্রতিষ্ঠা করে প্রতিষ্ঠাতা সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর সময়কাল ছিলো ২০০৫-২০০৮ পর্যন্ত। ২০১২ সালে ১৭ ফেব্রুয়ারি তাঁর প্রভুর ডাকে না ফেরার দেশে চলে যান।তাঁর মৃত্যুতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ইসলামিক স্টাডিজ পরিবার শুধু একজন শিক্ষককে নয় একজন অভিভাবককেও হারিয়েছে। তাঁর মৃত্যুতে এই পরিবার আজও শোকাহত।