ক্ষণজন্মা হাদীস বিশারদ আল্লামা ফখরুদ্দীন  

        

       সাঈদ চৌধুরী


আমার ওস্তাদ প্রখ্যাত ইসলামি ব্যক্তিত্ব আল্লামা ফখরুদ্দীন ছিলেন ইলমে হাদিস, ফিকহ ও তাসাউফ বিশেষজ্ঞ। জাতির মেধাবী মানুষ গড়ার কারিগর। আলিয়া মাদ্রাসার ছাত্রদের কাছে নক্ষত্রতুল্য এবং শিক্ষকদের মধ্যে ক্ষণজন্মা হাদীস বিশারদ হিসেবে সমধিক খ্যাত। 

সিলেট সরকারী আলিয়ার সাবেক প্রিন্সিপাল আল্লামা ফখরুদ্দীন ছিলেন গুনী অধ্যাপক ও অভিজ্ঞ প্রশাসক। কর্মজীবনে দীর্ঘ সময় তিনি সিলেট ও ঢাকা আলিয়ার হোস্টেল সুপার ছিলেন। সিলেট আলিয়ায় প্রিন্সিপাল মনোনীত হবার আগে ভাইস প্রিন্সিপাল ও ভারপ্রাপ্ত প্রিন্সিপাল ছিলেন। অত্যন্ত যোগ্যতার সাথে সর্বত্র দায়িত্ব পালন করেছেন।       

১৯৬৮ সালের ৩১ অক্টোবর আল্লামা ফখরুদ্দীন সিলেট আলিয়ায় শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। এরপর কয়েক দফা ঢাকা ও সিলেট আলিয়ায় বদলি ও প্রমোশন হয়েছে। ১৯৮৯ সালের ৫ আগস্ট যখন ঢাকা থেকে সিলেট আসেন তখন আমি সিলেট আলিয়া মাদ্রসার ছাত্র। ১৯৯৩ সালে তিনি সিলেট জেলা থেকে জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ শিক্ষক হিসেবে পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেন।    

আমি খুব সৌভাগ্যবান যে, সিলেট আলিয়ায় আল্লামা ফখরুদ্দীন জনাব ছাড়াও অধ্যক্ষ মাওলানা আব্দুল মান্নান, অধ্যক্ষ কাজী সালাহ উদ্দীন ইব্রাহীম, শায়খুল হাদিস আল্লামা জিল্লুর রহমান, অধ্যাপক মাওলানা সিরাজুল ইসলাম, মাওলানা নুরুল ইসলাম চতুলি সহ দেশ বরেণ্য ওস্তাদদের সান্নিধ্য পেয়েছি।

আল্লামা ফখরুদ্দীন মুহাদ্দিস হিসেবে দীর্ঘ দিন হাদিসের পঠন-পাঠনের ফলে গভীর পাণ্ডিত্যের অধিকারী ছিলেন। এক ধরণের হাফিজ মনে হত। ক্লাসে একটা হাদিস ব্যাখ্যা করতে গিয়ে অসংখ্য হাদিস থেকে বর্ণনা দিতেন। 

وَأَمَّا بِنِعۡمَةِ رَبِّكَ فَحَدِّثۡ 

বলে আল্লাহপাক মহানবী সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়াসাল্লামকে সম্বোধন করেছেন। বলেছেন, “আর আপনার রবের অনুগ্রহ আপনি বর্ণনা করুন”।  অর্থাৎ রিসালাতের যে নিয়ামত দিয়ে আপনাকে প্রেরণ করা হয়েছে তা পৌঁছে দিন।  

আল্লামা ফখরুদ্দীন ক্লাসের আলোচনায় প্রায়ই রিসালাত এবং ওয়ারাসাতুল আম্বিয়ার গুরুত্ব বিশ্লেষন করতেন। অত্যন্ত গভীর ভাবে অতীত ঐতিহ্য ও আজকের প্রত্যাশা তুলে ধরতেন। আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য বাতলে দিতেন। 

মিশকাতুল মাসাবিহ অধ্যয়ন কালে 

العلماء ورثة الا نبياء

অর্থাৎ আলেমরা হলেন নবী-রসুলদের উত্তরসূরি। একথা বুঝাতে বেশ কয়েকদিন ক্লাস নিয়েছেন।  

অনেকের ধারণা আল্লামা ফখরুদ্দীন কম কথা বলতেন। আসলে তিনি বাজে কথা কম বলতেন। তার প্রতিটি নিঃশ্বাসে তসবিহ অথবা তা’লিম ছিল। প্রত্যেকটি কথা ও উচ্চারণ মহান মাবুদের অনুগ্রহ হাসিলের পাথেয় ছিল। জ্ঞানের বিষয়ে তিনি প্রচুর বলতেন। তার কথার মাঝে আলোর ঝলক ছিল। মাঝে মধ্যে রসিকতাও করতেন। তাতেও একটা আর্ট ছিল। জ্ঞান ও সৌন্দর্য্যে ভরপুর ছিল।

সিলেট আলিয়ায় আমি ছিলাম তার সবচেয়ে প্রিয়পাত্র। আর তিনি ছিলেন আমার পিতার বন্ধু। আব্বা ডা. এম এম সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী পাকিস্তান আমলে কয়েকবার সিলেট সার্কেল আট-এ স্যারপঞ্চ ছিলেন। তিনি সাবেক চট্রগাম বিভাগীয় স্যারপঞ্চ এসোসিয়েশনের সভাপতি ছিলেন। চট্রগাম, কুমিল্লা ও সিলেট নিয়ে ছিল এই বিভাগ। খুবই মেধাবী ও দূরদর্শী মানুষ ছিলেন। আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু সহ চট্রগাম অঞ্চলের বিশিষ্ট জনের সাথে সখ্য ছিল। একই কারণে আল্লামা ফখরুদ্দীনও ছিলেন তার কাছের মানুষ। 

এছাড়া ফখরুদ্দীন জনাব আমার মামা মাওলানা সাঈদুল হাসান সাহেবের খুবই ঘনিষ্ট ছিলেন। মামাও সিলেট আলিয়ায় এক সময় সফল হোস্টেল সুপার এবং বিজ্ঞ মুহাদ্দিস হিসেবে জনপ্রিয় ছিলেন। ফলে জনাবের সাথে আমার এক ধরনের পারিবারিক সম্পর্ক ছিল। 

ফখরুদ্দীন জনাবের সুযোগ্য সন্তান মুহাম্মাদ ইমাদউদ্দীন আমার কাছ থেকে স্মৃতিচারণমূলক লেখা চেয়ে আমাকে মুগ্ধ করেছেন। আমার এই প্রিয় শিক্ষকের কথা ভাবতে গিয়ে অনেক স্মৃতি মনে পড়ছে। 

আলিয়া মাদ্রাসায় অধ্যয়ন কালেও আমি সাংবাদিকতার সাথে জড়িত ছিলাম। জাতীয় দৈনিকে কাজ শুরু করেছি দাখিল নবম শ্রেণির ছাত্র হিসেবে। তখনই সিলেট প্রেস ক্লাবের সদস্য এবং নির্বাহী কমিটিতে ছিলাম। সাহিত্য-সংস্কৃতি ও সমাজসেবা সম্পাদক হিসেবে দু’বার মাদ্রাসা ছাত্র সংসদে প্রতিনিধি হয়েছি। আলিয়ার দেয়ালিকা সম্পাদনা ও বার্ষিকী প্রকাশনায় সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলাম। ফলে মাদ্রাসা প্রশাসনের সাথে কাজ করতে হয়েছে। 


সাধারণ ছাত্ররা ফখরুদ্দীন জনাবের সামনে পড়তে সাহস করতেন না। কারণ তিনি জানতে চাইতেন আজকের ক্লাসে কোন্ হাদিস বা ফিক্হ আলোচনা হবে, ঠিকমত পড়ে এসেছেন কিনা, ইত্যাদি। কিন্তু আমাকে পেলে মুসলিম দুনিয়ার সর্বশেষ খবর নিতেন। আমার মাধ্যমে জানা হয়ে যায় বলে তাকে আর পত্রিকা ঘাটতে হয়না। এজন্য প্রায়ই তার নিজের জন্য রাখা বিস্কুট থেকে আমাকে এক টুকরো খেতে দিতেন। আমিও এটাকে নিয়ামত হিসেবে গ্রহন করতাম। ফখরুদ্দীন জনাব ছিলেন খুব দিলদারাজ। তবে অসম্ভব স্বচ্ছ ছিলেন। এসব ক্ষেত্রে অফিসের পয়সা খরচ না করে পকেটের পয়সা খরচ করতেন।

আমি ২০০০ সালে লন্ডন চলে আসার পর ফখরুদ্দীন জনাব প্রথমে ভাইস প্রিন্সিপাল এবং পরে প্রিন্সিপাল হয়ে ২০০৬ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেছেন। দেশে গিয়ে আমি দেখা করেছি। অনেক দিন পর কাছে পেয়ে কী অপার মমতায় জড়িয়ে ধরে ছিলেন। আমি যে তার ছাত্র, উপস্থিত কেউ সেটা ভাবেননি। পুরনো বন্ধুর মত মনে হয়েছে। তিনি ছিলেন বট বৃক্ষের মত ছায়ময়, মায়াময়।  

ফখরুদ্দীন জনাব সবসময় শেরওয়ানি ধাঁচের পাঞ্জাবি ব্যবহার করতেন। তিনি ছিলেন সুন্দর স্বভাবের অধিকারি সুদর্শন ও পরিপাটি মানুষ। সৎ, নিষ্ঠাবান ও দায়িত্বশীল। খুবই ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন ও ইতিহাস সচেতন। আর দশজন মানুষের তুলনায় কিছুটা আলাদা। তাকে দেখে যেকোন বিষয়ে প্রশ্ন করে শেখে নেবার আগ্রহ জাগে। অত্যন্ত কঠিন বিষয়কে সহজ ও সুন্দর করে ব্যাখা করতেন। ফিক্হি মাসায়েল পরিষ্কারর করে বর্ণনা করতেন। তার ইলমী বিচক্ষণতায় সকলেই মুগ্ধ হতেন।  

একজন আদর্শ শিক্ষকের মধ্যে যেসব মানবিক গুনাবলী থাকা অত্যাবশ্যক, ফখরুদ্দীন জনাবের সেটা ছিল। শিক্ষকতাকে পেশা নয়, ব্রত হিসেবে গ্রহন করেছিলেন। সুন্দর বাচনভঙ্গি ও দূরদর্শীতা, সুনির্দিষ্ট বিষয়ে জ্ঞানের গভীরতা এবং আকর্ষনীয় উপস্থাপনায় আমরা আপ্লুত হতাম। তিনি ছিলেন কৌশলী ও বন্ধুবৎসল। মোস্ট ইনফ্লুয়েনশিয়াল টিচার। মানসম্মত পাঠদান পদ্ধতি ও শৃঙ্খলাবদ্ধতার জন্য তিনি স্মরণীয় হয়ে আছেন। শিক্ষার আলোয় আমাদের মনকে আলোকিত ও বিকশিত করেছেন। তার হাতের লেখা ছিল খুবই সুন্দর। ভাষাও চমৎকার, সাহিত্য সমৃদ্ধ।    


শিক্ষা জীবন থেকে প্রখর মেধাবী আল্লামা ফখরুদ্দীন ১৯৫৬ সালে দাখিল পরীক্ষায় কৃতিত্ব অর্জন করেন। এরপর বারবার মেধা তালিকায় স্থান পেয়েছেন। ১৯৬০ সালে আলিম ১ম বিভাগ, ১৯৬২ সালে ফাজিল ১ম বিভাগে ৫ম স্থান, ১৯৬৪ সালে কামিল (হাদীস) ১ম বিভাগে ২য়, ১৯৬৬ সালে কামিল (ফিকহ) ১ম বিভাগে ১ম, ১৯৬৭ সালে ডিপ্লোমা ইন-আদীব ১ম বিভাগে ১ম, ১৯৬৮ সালে ডিপ্লোমা ইন-আদীব-ই-কামিল ১ম বিভাগে ১ম স্থান অধিকার করেন। ১৯৬৪ সালে ঢাকা আলিয়ার স্কলারশীফ নিয়ে আল্লামা আব্দুর রহমান কাশগড়ির তত্ত্বাবধানে “ফোকাহায়ে ইষ্ট পাকিস্তান কে ফেক্হী কারনামে” অভিসন্দর্ভ গবেষণা করে তিনি রিচার্স স্কলার সনদ লাভ করেন।  

ঢাকা ও সিলেট আলিয়া থেকে প্রকাশিত ম্যাগাজিনে আল্লামা ফখরুদ্দীনের অনেক গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। দেশের বিভিন্ন জার্নাল এবং ম্যাগাজিনেও তিনি লিখেছেন। সিহাহ সিত্তার হাদীস সমূহের ইযাযত সম্বলিত তার লিখিত সনদ প্রকাশিত হয়েছে। হাদীস, উসূলে হাদীস ও আছমাউর রেজাল সম্পর্কে চমৎকার গবেষণা প্রবন্ধ লিখেছেন তিনি। “মাখযানুল উলূম” নামে পান্ডুলিপি প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে।  

আল্লামা ফখরুদ্দীন চট্টগ্রাম জেলার চন্দনাইশ মাওলানা মঞ্জিলে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মুফতি শফিউর রহমান ছিলেন প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন। তিনি চন্দনাইশে হাশিমপুর মকবুলিয়া সিনিয়ার মাদ্রাসা এবং জোয়ারা ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা। যোগ্য বাবার সার্থক উত্তরাধিকারী হিসেবে আল্লামা ফখরুদ্দীন এই দ্বীনের বাগানে খাদিম হিসেবে কাজ করে গেছেন। 

পারিবারিক জীবনে ফখরুদ্দীন জনাবের ৫ সন্তানের মধ্যে বড় ছেলে জালালুদ্দীন টিকা গ্রুপের মডার্ণ পলি ইন্ডাস্ট্রির এইচআর এডমিন ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত। আল্লামা ফখরুদ্দীন (রহ) ওয়েলফেয়ার সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করছেন। দ্বিতীয় ছেলে জায়নুদ্দীন চট্টগ্রামে এক্সিম ব্যাংকে কর্মরত। কনিষ্ঠ ছেলে সুলেখক  ইমাদউদ্দীন ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ গোপালগঞ্জ শাখায় কর্মরত। মেয়ে নূরুন্নাহার আক্তার পারভীনের স্বামী আমিনুর রহমান চট্টগ্রামে জোয়ারা ইসলামিয়া ফাজিল মাদরাসায় অধ্যক্ষ। অপর মেয়ে আমাতুলমাওলা মারজানার স্বামী আবু বকর সিদ্দিক ঢাকায় ফ্লোরা লিমিটেডের ডিজিএম।  


সিলেট আলিয়া থেকে সরকারি ভাবে অবসর গ্রহনের পর আল্লামা ফখরুদ্দীন ঐতিহ্যবাহী চুনতী হাকীমিয়া আলিয়া মাদ্রাসায় শায়খুল হাদীস হিসেবে আমৃত্যু বেসরকারি ভাবে শিক্ষাদান করেছেন। চন্দনাইশের এয়াকুব মরিয়ম জামে মসজিদে খতিব হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১১ সালের ২৬ মে রাত সোয়া ১২টায় আল্লামা ফখরুদ্দীন মাবুদের সান্নিধ্যে চলে গেছেন। মহান আল্লাহ আমাদের প্রিয় ওস্তাদকে জান্নাতে উচ্চ মাকাম দান করুন। আমিন।


লেখক: সাঈদ চৌধুরী। 

কবি ও কথা সাহিত্যিক। সম্পাদক- সময় (অনলাইন দৈনিক), ইউকে বাংলা ডাইরেক্টরি, ইউকে এশিয়ান রেষ্টুরেন্ট ডাইরেক্টরি ও মুসলিম ইনডেক্স (ওয়ার্ল্ডওয়াইড)

প্রকাশক : কাজী জসিম উদ্দিন   |   সম্পাদক : ওয়াহিদুজ্জামান

© Deshchitro 2024