ইসরায়েলে নতুন করে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে ইরান কাছের মানুষকে আলিঙ্গন করা কেন জরুরি? একদিনে আরও ২৬ জনের করোনা শনাক্ত, মৃত্যু ১ পাল্টা হামলার মুখে যাত্রী ছাড়াই বিদেশে বিমান সরিয়ে নিচ্ছে ইসরায়েল জাতীয় নির্বাচনের তারিখ নিয়ে সমাঝোতা একটি ইতিবাচক দিক : আতিকুর রহমান জামায়াতের ১নং ওয়ার্ড কর্তৃক সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত নাগেশ্বরীতে বাণিজ্যমেলা বন্ধের দাবিতে মানববন্ধন রায়গঞ্জে মাছ ধরতে গিয়ে পানিতে ডুবে ভাই বোনের মর্মান্তিক মৃত্যু সাতক্ষীরা কালিগঞ্জে আওয়ামী লীগ নেতা মোজাহার হোসেন কান্টু গ্রেপ্তার শ্রীপুরে দফায় দফায় হামলা ও ভাঙচুর, অর্ধশতাধিক বাড়িঘর ও দোকানপাটে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ লালপুরে জামায়াতের ঈদ পুনর্মিলনী অনুষ্ঠিত লালপুরে বিএনপির ঈদ পুনর্মিলনীতে জনতার ঢল! ঈশ্বরগঞ্জে সড়ক দুর্ঘটনায় ১ জন নিহত সাবেক সংরক্ষিত এমপি’র বাড়িতে যৌথবাহিনীর অভিযান: ইয়াবা-অস্ত্রসহ পুত্র আটক সুন্দরগঞ্জে জামায়াত কর্মী হত্যা মামলায় যুবলীগ নেতা আজম কারাগারে কালাইয়ে দুধর্ষ ডাকাতির ঘটনায় চিকন আলী নামে এক আন্তজেলা ডাকাত দলের সদস্য গ্রেপ্তার পাঁচ ব্যাংক মিলে হচ্ছে এক ব্যাংক, চাকরি হারাবেন না কর্মীরা নেতানিয়াহুর জন্য বিশ্ব আরও বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে’ গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হককে অবরুদ্ধের প্রতিবাদে পীরগাছায় মশাল মিছিল সড়ক দুর্ঘটনায় লালপুরের যুবকের মৃত্যু

ইলমে হাদিসের বাতিঘর আল্লামা ফখর উদ্দিন (রহ.)

ইলমে হাদিসের বাতিঘর আল্লামা ফখর উদ্দিন (রহ.)


বায়েজীদ মাহমুদ ফয়সল


শায়খুল হাদীস আল্লামা ফখর উদ্দিন (রহ.) ছিলেন ইলমে হাদিস, ফিকহ ও তাসাউফ বিশেষজ্ঞ। তাঁর হাত ধরেই তৈরি হয়েছেন অসংখ্য আলেমে দ্বীন এবং ইসলামী চিন্তাবিদ। সত্যিকার অর্থেই তিনি ছিলেন ইলমে দ্বীনের এক আলোকিত রাহবার। তিনি এমন একটি সময়ে জন্মগ্রহণ করেছেন, যখন এ উপমহাদেশে ইলমে দ্বীনের আলো একেবারে নিভু নিভু পর্যায়ে ছিল। আল্লামা ফখর উদ্দিন (রহ.)-এর মতো ক্ষণজন্মা নিবেদিতপ্রাণ আলেমে দ্বীনের পদচারণায় সবুজ শ্যামল বাংলায় দ্বীনের প্রচার ও প্রসারের কাজ গতিশীল হয়েছিল। মূলত যেসব মহামনীষীরা তাঁদের ত্যাগ-তিতিক্ষা, মেধা, দক্ষতা, যোগ্যতা এবং সামগ্রিক প্রচেষ্টাকে ইলমে দ্বীনের জন্য নিবেদিত করেছেন শায়খুল হাদীস ফখর উদ্দিন (রহ.) ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম। তাঁর পুরো জীবনটাই ছিলো এক আল্লাহর সন্তুষ্টিকে কেন্দ্র করে আবর্তিত। তাঁর ব্যক্তিজীবনে খোদাভীরুতা, নিষ্ঠা, আন্তরিকতা এবং ইলমে দ্বীনের প্রচার ও প্রসারে আত্মত্যাগ আলেম সমাজের মধ্যে উজ্জ্বল নক্ষত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিল।


ক্ষণজন্মা এই আলেমে দ্বীন ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের ১ মার্চ চট্টগ্রাম জেলার চন্দনাইশ উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আল্লামা মুফতি শাফিউর রহমান (রহ.) এবং মাতার নাম মোসাম্মাৎ আসেমা খাতুন। তিনিও ছিলেন চট্টগ্রাম অঞ্চলের বিখ্যাত আলেম ও ফকিহ। তিনি চট্টগ্রামে হাশিমপুর মকবুলিয়া সিনিয়র মাদ্রাসা এবং জোয়ারা ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসা নামে দু’টি আলিয়া মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।


আল্লামা ফখর উদ্দিন (রহ.) নিজ এলাকার কদলপুর ফাজিল মাদ্রাসা থেকে ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে দাখিল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তিনি ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে দারুল উলুম আলিয়া মাদ্রাসা, চট্টগ্রাম থেকে আলিম পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। এরপর ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে একই মাদ্রাসা থেকে ফাজিল পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে পঞ্চম স্থান লাভ করেন। পরবর্তীতে উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি ঢাকায় চলে যান এবং ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসার কামিল হাদিস বিভাগে ভর্তি হন। তিনি ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসা থেকে দুইবার দুই বিভাগে কামিল পাশ করেন। প্রথমবার ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে হাদিস বিভাগ নিয়ে প্রথম বিভাগে দ্বিতীয় স্থান এবং ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে ফিকহ বিভাগে প্রথম বিভাগে প্রথম স্থান লাভ করেন। ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসার স্কলার্সশিপ নিয়ে আল্লামা আব্দুর রহমান কাশগরী (রহ.)-এর তত্ত্বাবধানে ‘ফোকাহায়ে ইস্ট পাকিস্তান-কে ফেকহি কারনামে’ অভিসন্দর্ভ গবেষণা করে তিনি গবেষক সনদ লাভ করেন। এছাড়াও তিনি ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে ডিপ্লোমা ইন-আদিব প্রথম বিভাগে প্রথম, ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দে ডিপ্লোমা ইন আদিব-ই-কামিল প্রথম বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করেন।


কর্মজীবনের শুরুতে ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দের ৩১ অক্টোবর আল্লামা ফখর উদ্দিন (রহ.) সিলেট আলিয়া মাদ্রাসায় জুনিয়র মৌলভী শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দের ৫ ফেব্রুয়ারি আরবি বিষয়ের সহকারি সিনিয়র মৌলভী পদে ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসায় বদলি হন। ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দের ১০ ফেব্রুয়ারি পুনরায় সিলেট আলিয়া মাদ্রাসায় প্রভাষক পদে উন্নীত হয়ে পুনরায় যোগদান করেন। আবার তিনি ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দের ২২ অক্টোবর কুরআন ও তাফসীর বিভাগের সহকারি অধ্যাপক পদে উন্নীত হয়ে ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসায় চলে যান। এরপর তিনি ২০০০ খ্রিস্টাব্দের ২৮ অক্টোবর ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে সিলেট আলিয়া মাদ্রাসায় স্থায়ীভাবে চলে আসেন। তিনি ২০০২ খ্রিস্টাব্দের ২২ জানুয়ারি উপাধ্যক্ষের দায়িত্ব লাভ করেন। উপাধ্যক্ষ থাকাকালীন তিনি একাধিকবার ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেছেন। সবশেষে তিনি ২০০৪ খ্রিস্টাব্দের ০৪ নভেম্বর পূর্ণ অধ্যক্ষের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি ২০০৬ খ্রিস্টাব্দের ২৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এই দায়িত্ব পালন করেন। কর্মজীবনে তিনি ঢাকা এবং সিলেট আলিয়া মাদ্রাসায় দীর্ঘ সময় ধরে হোস্টেল সুপারের দায়িত্ব পালন করেছেন। এর ফলে ছাত্রদের তিনি ভালোমত দারস দেওয়ার সুযোগ পেতেন এবং ছাত্রদের মধ্যে তিনি অনেক বেশি জনপ্রিয় ছিলেন। তিনি একজন বহুভাষাবিদ আলেমে দ্বীন ছিলেন। একই সঙ্গে বাংলা, আরবি, উর্দু, ইংরেজি, ফারসি প্রভৃতি ভাষায় সমান দক্ষ ছিলেন। ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি সিলেট জেলা থেকে জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ শিক্ষক হিসেবে পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেন। সিলেট আলিয়া মাদ্রাসা থেকে সরকারি ভাবে অবসর গ্রহণের পর আল্লামা ফখর উদ্দিন (রহ.) চট্টগ্রামের চুনতি হাকিমিয়া আলিয়া মাদ্রাসায় শায়খুল হাদিস হিসেবে আমৃত্যু শিক্ষাদান করেন। এছাড়াও তিনি চন্দনাইশ উপজেলার এয়াকুব মরিয়ম জামে মসজিদে খতিব হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।


ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসা ও সিলেট আলিয়া মাদ্রাসা থেকে প্রকাশিত ম্যাগাজিনে আল্লামা ফখর উদ্দিন (রহ.)-এর অনেক গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। দেশের বিভিন্ন জার্নাল এবং ম্যাগাজিনেও তিনি অনেক প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখেছেন। সিহাহ সিত্তার হাদিস সমূহের ইজাজত সম্বলিত তাঁর লিখিত সনদ প্রকাশিত হয়েছিল। এছাড়াও তিনি হাদিস, উসুলে হাদিস ও আছমাউর রেজাল সম্পর্কে চমৎকার গবেষণা প্রবন্ধ লিখেছেন। তিনি তাঁর সমস্ত লেখা ও প্রবন্ধ সংগ্রহ করে মাখযানুল উলুম নামকরণ করেছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তা আজও প্রকাশিত হয়নি। এগুলো প্রকাশিত হলে মুসলিম উম্মাহ অনেক উপকৃত হতো।


আল্লামা ফখর উদ্দিন (রহ.)-এর হাত ধরে এমন অসংখ্য আলেমে দ্বীন এবং দাঈ ইলাল্লাহ তৈরি হয়েছেন যারা দেশ-বিদেশে সম্মান ও গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেছেন। পাশাপাশি অত্যন্ত নিষ্ঠা এবং আন্তরিকতার সঙ্গে দ্বীনের খেদমত করে যাচ্ছেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন- ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আল-হাদিস বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.)। তিনি একাধারে একজন দাঈ, গবেষক এবং প্রাজ্ঞ আলেমে দ্বীন ছিলেন। তিনি পঞ্চাশের অধিক গ্রন্থ রচনা করেছেন। তাঁর রচিত গ্রন্থগুলো দ্বীনি মহলে অত্যন্ত গ্রহণযোগ্যতা এবং সমাদর লাভ করেছে। এছাড়াও রয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. নকীব মোহাম্মদ নসরুল্লাহ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আবু বকর মুহাম্মাদ জাকারিয়া, প্রফেসর ড. মো. ময়নুল হক, প্রফেসর ড. আহসান উল্লাহ ফয়সল, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. আহমদ আবুল কালাম, বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ ড. আবুল কালাম আজাদ, বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ ও গবেষক ড. আব্দুস সালাম আজাদী প্রমুখ। উপরন্তু তাঁর হাতে গড়া হাজার হাজার আলেমে দ্বীন বিভিন্ন মাদ্রাসা, মসজিদ এবং বিভিন্ন দাওয়া সেন্টার ও দ্বীনি কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত রয়েছেন।


আল্লামা ফখর উদ্দিন (রহ.)-এর চরিত্রে ছিল মহানুভবতার উজ্জ্বল প্রতিচ্ছবি। তিনি একজন নিরহংকার খালেস মুখলেস দ্বীনের দাঈ ছিলেন। এছাড়াও তাঁর চরিত্রের অন্যতম গুণ ছিল তিনি মানুষকে খুব সহজেই আপন করে নিতেন। বিশেষ করে মাদ্রাসার ছাত্র, শিক্ষক ও কর্মচারীসহ সকলের সঙ্গে তাঁর ছিল হৃদ্যতার সম্পর্ক। সবার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণে তিনি ঐক্য, শান্তি এবং আত্মার সম্পর্ক গঠনের প্রতি জোর দিতেন। এতে ছাত্র, শিক্ষক এবং কর্মচারীরা আরো বেশি তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়তো। বিনয়, শ্রদ্ধাবোধ, নিয়মানুবর্তিতা, গভীর জ্ঞানের চর্চা আর শিক্ষণীয় রসিকতা তাঁর ব্যবহারিক জীবনের অনুষঙ্গ ছিল। এজন্য দেখা যায়, তিনি একই সঙ্গে কুরআন, হাদিস, ইজমা, কিয়াস এবং মাসলা-মাসায়েলসহ বিভিন্ন বিষয়ে অনর্গল যৌক্তিক, তত্ত্ব ও তথ্যগত কথা বলতে পারতেন। আমার শিক্ষা জীবনে যে ক’জন প্রাজ্ঞ আলেমে দ্বীনের সাহচর্য পেয়েছি তিনি তাঁদের মধ্যে অন্যতম। তিনি আমার অত্যন্ত প্রিয় শিক্ষক ছিলেন। প্রতিটি বিষয়ের বর্ণনায় তিনি বিশদ আলোচনা করতেন। এ সময় কুরআন-হাদিসসহ ধর্মতত্তে¡র বিভিন্ন বিষয়ের আলোচনায় তাঁর গভীর জ্ঞানের পরিচয় লক্ষ করতাম। তাঁর মধ্যে অন্যতম গুণ ছিল তিনি পাঠদানের সময় পিতৃতুল্য মনোভাব নিয়ে শাসন করতেন। তাঁর পাঠদানের সময় ছাত্রদের সর্বোচ্চ উপস্থিতি পরিলক্ষিত হতো। ভালোবাসা এবং জ্ঞান আদান-প্রদান এই দুটি বিষয়ের প্রতি তিনি খুব বেশি জোর দিতেন। অর্থাৎ, ছাত্রদের হৃদয়ে ইলমে দ্বীন অর্জনের প্রতি ভালোবাসাকে তিনি জাগিয়ে তুলতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করতেন। যাতে একজন ছাত্র ইলম অর্জনকেই তাঁর জীবনের মাকসাদ বানিয়ে নেয়। সিলেট সরকারি আলিয়া মাদ্রাসায় অধ্যয়নকালে তাঁর খুব বেশি একটা সাহচর্য না পেলেও বুঝতে পেরেছি সত্যবাদিতা, নিয়মানুবর্তিতা, পরিচ্ছন্নতা, ভালোবাসা, কাজের স্বচ্ছতা, দ্বীনের কাজে তিনি অত্যন্ত নিবেদিতপ্রাণ ব্যক্তিত্ব।


আল্লামা ফখর উদ্দিন (রহ.) দীর্ঘদিন মুহাদ্দিস হিসেবে হাদিস পাঠদান করেন। এর ফলে হাদিসের ওপর তিনি গভীর পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। বিশেষ করে হাদিস বর্ণনা এবং আলোচনায় তিনি যে পদ্ধতি অনুসরণ করতেন তাতে মনে হতো তিনি একজন হাফিজুল হাদিস। কারণ, একটি হাদিস ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি অসংখ্য হাদিসের রেফারেন্স দিতেন। একই বক্তব্য বিভিন্ন রাবীর বর্ণনায় হাদিসে এসেছে, এরকম হাদিসের বর্ণনায় তিনি ছিলেন অত্যন্ত দক্ষ এবং প্রাজ্ঞ ব্যক্তিত্ব। দ্বীনের প্রচার ও প্রসারে তিনি রাসুল (সা.)-এর সিরাতকে আর্দশকে খুবই গুরুত্ব দিতেন। আল্লাহ তায়া’লা রাসুল (সা.)-কে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘(হে নবী) আর আপনি আপনার রবের অনুগ্রহ বর্ণনা করুন।’ অর্থাৎ, আপনাকে যে রিসালাতের দায়িত্ব প্রদান করেছেন সেটাকে মানুষের কাছে পৌঁছে দিন। আল্লাহ তায়া’লার এই ঘোষণার পর রাসুল (সা.) অত্যন্ত নিষ্ঠা এবং আন্তরিকতার সাথে এই দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর পুরোটা জীবন এই জীবনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য মোজাহাদা করেন। আর তাঁর উম্মতের জন্য রেখে যান এক অনুপম আদর্শ। রাসুল (সা.) বলেন, তোমরা যা জানো, তা অন্যের কাছে হুবহু পৌঁছে দাও। এই হাদিস থেকে বুঝা যায়, রাসুল (সা.) যে রিসালাতের দায়িত্ব পালন করেছেন, তাঁর উম্মতের প্রতি সেই দায়িত্বই বর্তায়। তবে এই দায়িত্ব পালনের জন্য আলেমরা সবচেয়ে বেশি উপযোগী। কারণ, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আলেমরা হলেন নবী-রাসুলদের উত্তরসূরি।’ তাদেরকে নায়েবে রাসুল বলা হয়। অর্থাৎ, রাসুল (সা.)-এর অবর্তমানে আলেমরাই এই দ্বীনি দায়িত্ব পালন করবেন। আল্লামা ফখর উদ্দিন (রহ.) একজন আলেমে দ্বীন হিসেবে সেই দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি এই দায়িত্ব পালনে এত বেশি সচেতন এবং আন্তরিক ছিলেন যে তা ভাবার মতো নয়। এজন্য দেখা যেতো তিনি ক্লাসে প্রায় রিসালাত এবং ওয়ারাসাতুল আম্বিয়ার গুরুত্ব বিশ্লেষণ করতেন। অত্যন্ত যৌক্তিক এবং মমত্ববোধের সঙ্গে মুসলিমের সোনালি ইতিহাস তুলে ধরতেন। এর মধ্যেও ফুটে উঠতো মুসলমানদের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা। তাঁর চিন্তাচেতনায় দূরদর্শীতার প্রভাব লক্ষ করা যেতো। এর ফলে ছাত্রদেরকে মুসলিমের সোনালি অতীত ইতিহাস ও ঐতিহ্যের দিকে নিয়ে যেতেন, তারা ঈমানী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়। আল্লামা ফখর উদ্দিন (রহ.) তাঁর জীবনের শেষদিন পর্যন্ত সেই দ্বীনের খেদমত করেই কাটিয়েছেন, যাকে তিনি ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন।


একজন আদর্শ শিক্ষকের মধ্যে যেসব মানবিক গুণাবলি থাকা অত্যাবশ্যক, তাঁর মধ্যে এর সবটুকুই ছিল। শিক্ষকতাকে পেশা নয়, ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। সুন্দর বাচনভঙ্গি ও দূরদর্শীতা, সুনির্দিষ্ট বিষয়ে জ্ঞানের গভীরতা এবং আকর্ষণীয় উপস্থাপনায় তিনি অত্যন্ত দক্ষ ছিলেন। মানসম্মত পাঠদান পদ্ধতি ও শৃঙ্খলাবদ্ধতার জন্য তিনি স্মরণীয় হয়ে আছেন। তিনি নিজেও ইলমে ওহির শিক্ষায় আলোকিত হয়েছেন বিধায় তাঁর সংস্পর্শে যারাই এসেছেন তারাই আলোকিত ও বিকশিত হয়েছেন। তাঁর হাতের লেখা ছিল খুবই সুন্দর। তিনি অত্যন্ত প্রাঞ্জল, সহজবোধ্য এবং আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে কথা বলতেন। তাঁর ভাষাভঙ্গি চমৎকার এবং অত্যন্ত সাহিত্য সমৃদ্ধ ছিল। অত্যন্ত ছোট ছোট বাক্যে তিনি গভীর বিষয়কে ফুটিয়ে তুলতে পারতেন। এটা তাঁর মেধা এবং প্রাজ্ঞতার অনন্য গুণ ছিল।


শায়খুল হাদিস আল্লামা ফখর উদ্দিন (রহ.) ইলমে নববীর আলোকে নিজেকে তৈরি করেছিলেন। এই জন্য তিনি নববী সুন্নাহকে তাঁর জীবনে বাস্তবায়ন করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে চুপ থাকলো, সে মুক্তি পেলো।’ আল্লামা ফখর উদ্দিন (রহ.) এই হাদিসটিকে খুবই মেনে চলতেন। এজন্য দেখায় যায়, ব্যক্তিজীবনে তিনি অত্যন্ত কম কথা বলতেন। সবসময়ই অনর্থক কথাবার্তা পরিহার করে চলতেন। তিনি সর্বদা আল্লাহর স্মরণে মগ্ন থাকতেন। ইলমে দ্বীনের চর্চা, ওয়াজ-নসিহত এবং ব্যক্তিগত কাজ ছাড়া তাঁর প্রতিটি নিঃশ্বাসে তসবিহ অথবা তা’লিম ছিল। প্রত্যেকটি কথা ও উচ্চারণ মহান মাবুদের অনুগ্রহ হাসিলের পাথেয় ছিল। তবে কোনো ক্ষেত্রে জ্ঞানের প্রসঙ্গ এলে তিনি এড়িয়ে চলতেন না। প্রাসঙ্গিক আলোচনায় তিনি প্রচুর কথা বলতেন। তাঁর কথায় প্রতিভার আলোকছটা ছিল। যেকোনো কঠিন বিষয়কেও তিনি অত্যন্ত সহজভাবে আবার কখনো কখনো রসিকতার সঙ্গে উপস্থাপন করতেন। এতে দর্শক বা শ্রোতা সহজেই প্রকৃত বিষয়টি বুঝে নিতে পারতেন। তবে এর মধ্যেও একটি শৈল্পিক আবহ লক্ষ করা যেতো। জ্ঞান ও সৌন্দর্যে ভরপুর ছিল তাঁর জীবনের প্রতিটি কর্মকাণ্ড।


আল্লামা ফখর উদ্দিন (রহ.) সবসময় শেরওয়ানী ধাঁচের পাঞ্জাবি ব্যবহার করতেন। তিনি ব্যক্তিজীবনে অত্যন্ত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন এবং পরিপাটি মানুষ ছিলেন। চেহারায় সুদর্শন এবং স্বভাবে অমায়িক একটা ভাব সবসময় পরিলক্ষিত হতো যা তাঁর ব্যক্তিত্বকে ফুটিয়ে তুলতো। অত্যন্ত সৎ, নিষ্ঠাবান ও দায়িত্বশীল ব্যক্তি হিসেবে তিনি যেমনই সমাদৃত ছিলেন তেমনই ছিলেন খুবই ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন ও ইতিহাস সচেতন। তাঁর ব্যক্তিত্ব স্বতন্ত্রতায় পরিমার্জিত এবং পরিশীলিত ছিল। বিধায় তিনি ছিলেন সবার থেকে আলাদা। তাঁর সামগ্রিক জীবন এমনই একটি আলোয় প্রতিবিম্বিত হয়েছে এবং এই আলোর সংস্পর্শে তিনি নিজেকে একজন আল্লাহপ্রেমিক ও খোদাভীরু মানুষ হিসেবে তৈরি করেন। রাসুল (সা.) বলেছেন, সত্যিকার ঈমানদার সেই ব্যক্তি, যাকে দেখলে তোমার আল্লাহর কথা মনে পড়ে। আল্লামা ফখর উদ্দিন (রহ.) ছিলেন তেমনই একজন ব্যক্তিত্ব। সত্যিই তাঁকে দেখলে যেমন দ্বীনের প্রতি আগ্রহ জন্মাতো, তেমনই ইলমে দ্বীনের প্রতিও উৎসাহ সৃষ্টি হতো। এমনকি আলেম সমাজও তাঁর ইলমি বিচক্ষণতায় অত্যন্ত মুগ্ধ হতেন।


আল্লামা ফখর উদ্দিন (রহ.) নীতি নৈতিকতার প্রশ্নে সবসময় অটল ও অবিচল এবং আপোসহীন ছিলেন। অন্যায়কে তিনি কখনো প্রশ্রয় দেননি। কুরআন-সুন্নাহর মাপকাঠিতে যা কিছু অন্যায় সেটাকে অন্যায় বলতেন, যা ন্যায় সেটাকে ন্যায়ই বলতেন। এই নীতি থেকে তাঁকে কেউ কখনো সরাতে পারেনি। তাঁর ব্যক্তি চরিত্রে সত্যবাদিতা, তীক্ষ্ণ² দূরদর্শীতা, সাদাসিধে জীবনযাপন এবং আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুলের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল। এজন্য যেকোনো ব্যাপারেই তিনি একমাত্র আল্লাহর ওপর নির্ভরশীল এবং এ ক্ষেত্রে অবিচল থাকতেন। তিনি তাঁর শিক্ষার্থীদেরকে সেই চরিত্রের আলোকে উজ্জীবিত হওয়ার উৎসাহ দিতেন। তাঁর সামগ্রিক জীবন পরখ করলে বলা যায়, তিনি সত্যিকার অর্থেই ছিলেন একজন আদর্শ শিক্ষক এবং তার বাইরে একজন আদর্শ মানুষ।


আল্লামা ফখর উদ্দিন (রহ.) পারিবারিক জীবনে পাঁচ সন্তানের জনক ছিলেন। তাঁরা প্রত্যেকেই স্ব স্ব অবস্থানে সুপ্রতিষ্ঠিত। তাঁর বড় ছেলে জালাল উদ্দিন টিকা গ্রুপের মডার্ন পলি ইন্ডাস্ট্রির এইচআর এডমিন ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত আছেন। পাশাপাশি আল্লামা ফখর উদ্দিন (রহ.) ওয়েলফেয়ার সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন। দ্বিতীয় ছেলে জায়নুদ্দীন চট্টগ্রামে এক্সিম ব্যাংকে কর্মরত আছেন। কনিষ্ঠ ছেলে ইমাদ উদ্দিন ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ গোপালগঞ্জ শাখায় কর্মরত আছেন। পাশাপাশি লেখালেখিতেও তাঁর পদচারণা রয়েছে। মেয়ে নূরুন্নাহার আক্তার পারভীনের স্বামী আমিনুর রহমান চট্টগ্রাম জোয়ারা ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ। অপর মেয়ে আমাতুল মাওলা মারজানার স্বামী আবু বকর সিদ্দিক ঢাকায় ফ্লোরা লিমিটেডের ডিজিএম হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। উপমহাদেশের প্রখ্যাত হাদিস বিশারদ আল্লামা ফখর উদ্দিন (রহ.) ২০১১ খ্রিস্টাব্দের ২৬ মে রাত বারোটা পনেরো মিনিটে ৬২ বছর বয়সে দুনিয়ার মায়া ছেড়ে মাবুদের সান্নিধ্যে চলে যান।


বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন : যখন তুমি এসেছিলে ভবে/ কেঁদেছিলে তুমি/ হেসেছিলো সবে। এমন জীবন তুমি করিও গঠন/ মরণে হাসিবে তুমি কাঁদিবে ভুবন।’ সত্যিই আল্লামা ফখর উদ্দিন (রহ.) যেদিন পৃথিবীতে এসেছিলেন সেদিন চিরাচরিত নিয়ম অনুসারে কেঁদেই এসেছিলেন। তাঁর জীবনকে তিনি এমন একটি আলোয় পরিচালিত করেন, যা সবারই লক্ষ্য হওয়া উচিত। আল্লামা ফখর উদ্দিন (রহ.) এমন একটি জীবন গঠন করেছিলেন, যা সবার কাছে ছিল ঈর্ষণীয়। কুরআন-হাদিস চর্চাকে তিনি বানিয়েছিলেন সময় কাটানোর অনুষঙ্গ। ইলমের প্রচার ও প্রসারকে করেছিলেন জীবনের লক্ষ্য এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনকে করেছিলেন জীবনের প্রকৃত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। এই মানবিক উত্তম গুণাবলির সমন্বয়ে তিনি নিজেকে মোজাহাদায় নিবেদিত করেন। তিনি সারাজীবন মানুষকে প্রতিনিয়তই ডাকেন সত্য এবং সুন্দরের পথে। দ্বীনের প্রচার প্রসার এবং মানুষকে পরিশুদ্ধ করার পেছনে তাঁর ত্যাগ-তিতিক্ষা এবং সাধনা প্রজন্মের পর প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করবে। আল্লাহ তায়া’লা তাঁকে জান্নাতুল ফেরদাউস দান করুন। আমিন।


লেখক : প্রাবন্ধিক, প্রকাশক ও সংগঠক।

আরও খবর


deshchitro-6833f89dd90e7-260525111405.webp
Successful Expert Session on BAETE Accreditation and BAC Standards

২০ দিন ১৫ ঘন্টা ১৭ মিনিট আগে


deshchitro-681f700fbf928-100525092607.webp
প্রাথমিক শিক্ষা পদক ২০২৪ প্রদান

৩৬ দিন ৫ ঘন্টা ৫ মিনিট আগে


deshchitro-67f43796540e1-080425023742.webp
তরুণ কবি আল আমিন- বিদ্রোহী

৬৮ দিন ২৩ ঘন্টা ৫৪ মিনিট আগে


deshchitro-67e191a7116bc-240325110855.webp
স্বপ্ন আমার

৮৩ দিন ৩ ঘন্টা ২৩ মিনিট আগে